দেশে বর্তমানে শিক্ষক সংকট চরমে হলেও নিয়োগে অবহেলা চলছে অবহেলা। ফলে বেকার হয়ে আছেন অনেকে। দুঃখ বুকে অপেক্ষায় আছেন নিয়োগ বঞ্চিতরা। গত ২৬ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৫৮০ স্কুলে নেই প্রধান শিক্ষক’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৯টি। এর মধ্যে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে ৮৫০টি স্কুল। অর্থাৎ ৮৫০টি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। একইভাবে রাঙামাটি জেলায় ৬৭৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৩৩টিতেই প্রধান শিক্ষক নেই। যদিও নিয়মিত প্রধান শিক্ষক না থাকা বেশ কিছু স্কুলে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এভাবেই চলছে অধিকাংশ স্কুল। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় দেড় হাজারেরও বেশি (১ হাজার ৫৮০টি) স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম, কঙবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এই ৫ জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩৩টি। এর মধ্যে বর্তমানে ৩ হাজার ৫৩টি স্কুলে প্রধান শিক্ষক কর্মরত আছেন। বাকি ১ হাজার ৫৮০টি স্কুলে পদটি শূন্য। অর্থাৎ দেড় হাজারেরও বেশি স্কুলে বর্তমানে নিয়মিত প্রধান শিক্ষক নেই। অবশ্য, প্রাপ্ত তথ্যটি কয়েক মাস আগের হওয়ায় বর্তমানে শূন্য পদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা অফিসার হৃষীকেশ শীল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত বিশ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নিয়োগে দেখা যায়, নানান জটিলতার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর সময়মত শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে শিশুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, শিক্ষার মূল ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো একটি দেশের শিক্ষার মূল ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অদৃশ্য জটিলতার কারণে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। নিয়োগ বাণিজ্য ও নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতা যার অন্যতম প্রধান কারণ বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। তাঁরা বলেন, শিক্ষক পদ শূন্যের ভয়াবহতা ১৯৭৫ সাল থেকে চলে আসছে। স্বাধীনতার পর প্রথম নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্যানেল ব্যবস্থা ছিল। যার ফলে শিক্ষক পদ শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যানেলে অপেক্ষমান তালিকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে প্যানেল বা অপেক্ষমান তালিকা লোপ পাওয়ায় শিক্ষক সংকট প্রকট হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষক সংকট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকটা বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।
শিক্ষার যে বর্তমান সংকট, তার পেছনে রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের অভাব ও অপ্রতুলতা। শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর ‘শিক্ষার সংকট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, শিক্ষায় যে সংকট বিদ্যমান, তা মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। এই সংকট সবার কাছে শিক্ষা না পৌঁছানোর এবং যাদের কাছে তা পৌঁছাচ্ছে যথাযথ মানসম্পন্ন না হওয়ার। এই সংকটের আরও দিক আছে, যেমন: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া; পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়া; শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ অথবা গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব। শিক্ষার্থীরা যে নোট বই এবং কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে অথবা গণিত ও ভাষার ক্ষেত্রে তাদের যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তাও সংকটকে ঘনীভূত করছে।
শিক্ষার মান উন্নত হয় না ভালো শিক্ষক না থাকলে; বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি মানসম্পন্ন না হলে; শিক্ষাদান ও গ্রহণ আনন্দময় না হলে; শিক্ষায় হেরফের থাকলে; তিন-চার ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত থেকে গেলে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ এসব না থাকলে এবং শ্রেণিকক্ষ উজ্জ্বল ও আরামদায়ক না হলে। শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি সংকল্পবদ্ধ হয় শিক্ষাকে সংকটমুক্ত করতে, তাহলে ওই পথে অনেক দূরই এগিয়ে যাওয়া যাবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষক সংকটের সুরাহা করা জরুরি।