শিক্ষা ছাড়া কেউ এগিয়ে যেতে পারে না। শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে যেতে হয়। বিদ্যালয় ছাড়া শিক্ষা গ্রহণ করা যায় না। এজন্য সব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী হতে হয়। শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা শিশুকাল থেকে শুরু করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শিশুকালে শেষ করতে হয়। আমাদের দেশের আশি থেকে নব্বই ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন করে। সংখ্যার দিক থেকে অনেক বড় সাফল্য। এসব শিশুর প্রায় সত্তর ভাগ নিম্ন মাধ্যমিক এবং ষাট ভাগের মত মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছে যায়। এরা বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। এদের মধ্য থেকে শতকরা আশি–পঁচাশি ভাগ শিক্ষার্থী পাশ করে। পাশ করা শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ কলেজে ভর্তি হয়।
যে দশ ভাগ শিশু প্রাথমিকে ভর্তি হয়নি, আবার নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। সবমিলে প্রায় ত্রিশ ভাগ শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। কারো বয়স থেমে থাকে না। সব শিশুর বয়স বাড়তে থাকে। বিদ্যালয়ে না যাওয়া বা ঝরে পড়া শিশুরাও বেড়ে উঠে। কৈশরোত্তীর্ণ হয়ে তরুণে পরিনত হয়। কোন না কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যে কোন কাজ করতে হলে আগে সে কাজ শিখতে হয়। এখানেও শিক্ষার প্রয়োজন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে এসব কিছু শিখে নিতে হয়। পরিবেশ থেকেও অনেক কিছু শিখার আছে। প্রকৃতিও অনেক কিছু শিখায়। এসব শিক্ষা বাস্তবমুখী জীবন ধারনের শিক্ষা। বিদ্যালয়ে যেতে না পারা বা ঝরে পড়া শিশুদের মধ্য থেকেও অনেকে সাফল্য অর্জন করে।
সকল শিশু প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বই পুস্তক খাতা কলমের শিক্ষা। শিশুরা পরিবার থেকে বেশি শিক্ষা নেয়। সমাজ থেকেও তারা অনেক কিছু শিখে। প্রকৃতির কাছ থেকে শিশুরা অনেক কিছু শিখতে পারে। বিদ্যালয় বলি কিংবা সমাজ বলি শিশুদের জন্য পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের মধ্য দিয়ে শিশুরা বেড়ে উঠে, মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশুকে পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে চলতে হয়। পরিবেশই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। নিজের অজান্তে সে পরিবেশের ভাল মন্দের সঙ্গে মিশে যায়। এজন্য পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি শিশুর জন্য এক একটি স্কুল– যেখান থেকে শিশুরা প্রতিনিয়ত শিখে। বিদ্যালয়ে শিশুরা শুধু লেখাপড়া শিখে না। নিয়ম শৃঙ্খলা শিখে, আচরণ শিখে। আরেক জনের সঙ্গে কিভাবে মিশতে হয় এসবও শিখে। সহপাঠিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার যে আনন্দ তা বিদ্যালয় থেকে শিখে। শিশুর মনের জগতকে আলোকিত করে দিতে পারে বিদ্যালয়। শিশুর মন মানসিকতাকে বিকশিত করতে পারে বিদ্যালয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুর মননশীলতা তৈরীতে বিদ্যালয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।
বিদ্যালয়ে না গেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা যায় না। ফলে শতভাগ শিশু যেন বিদ্যালয়মুখী হয় সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বছর বছর শিক্ষার হারও বেড়ে চলছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের পড়ালেখার ভিত তৈরী হয়। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছার সোপান হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিম্ন মাধ্যমিকে এমন অনেক শিশু ভর্তি হয় যারা বাংলা বই দেখে দেখে পড়তে পারে না। অর্থাৎ ভাল করে রিডিং পড়তে পারে না। ইংরেজীতে ঠিক মত নাম লিখতে পারে না। এসব শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নিম্ন মাধ্যমিকে এসে ভর্তি হয়। উত্তীর্ণ শিশুদের উপরের শ্রেণীতে ভর্তি না করার সুযোগ নেই। এজন্য প্রাথমিকে শিশুদের যত্ন সহকারে গড়ে তোলতে হয়। নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখা করার উপযোগী করে তৈরী করতে হয়। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি।
শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ নেই। বড় বড় স্কুল ভবন গড়ে উঠেছে। দ্বিতল তিন তল ভবন দেখলে চোখ জুড়ে যায়। এসব স্কুলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক আছেন। অনেক শিক্ষক ডিগ্রীধারী, কেউ কেউ মাস্টার্সও করেছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও যথেষ্ট কিন্তু শিক্ষার অভাব লক্ষ্য করা যায়। মানসম্পন্ন শিক্ষা– যে শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠতে পারে। শিক্ষার মান নয় পাসের হার নিয়ে বিদ্যালয়গুলো উদ্বিগ্ন থাকে। পাবলিক পরীক্ষায় কত শিক্ষার্থী পাস করলো এর উপর নির্ভর করে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান। শিক্ষার্থীদের সত্তর থেকে পঁচাত্তর ভাগ এখনো গ্রামের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়ে ভাবার বা দেখার কেউ নেই। শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারলে সবাই খুশী। গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও অনেক শিক্ষার্থী ভাল ফলাফল করে। এখন ভাল ফলাফল দিয়ে শিক্ষার মান নির্ণয় করা যায় না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তবে এখানে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে তারা ভর্তির সুযোগ পায়। ভাল ফলাফল করা অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ভর্তির সুযোগ পায় তাদের শিক্ষার মান নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে বিরূপ মনোভাব দেখা যায়। অর্থাৎ আগেকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান অনেক ভাল ছিল। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীরা একসময়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে। সেখানে নানা রকম বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ঘাটতি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পূরণ করতে পারে না।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে মানবশিশু মানব সম্পদে পরিণত হয়। কোন কোন কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা যায় না। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের আর সুযোগ থাকে না। ফলে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় আর ফিরে যাওয়া যায় না। কেউ কেউ হয়তো নিজের প্রচেষ্টায় শিখে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশির ভাগ কর্মজীবীর ক্ষেত্রে তা আর হয়ে ওঠে না। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই শোনা যায় যোগ্যতা সম্পন্ন কর্ম দক্ষ লোকবলের অভাবের কথা। কোন কোন ক্ষেত্রে মেধাসম্পন্ন অফিসার খুঁজে পাওয়া যায় না। এধরনের জনবল কখনো মানসম্পন্ন কাজ বা উন্নত সেবা প্রদান করতে পারে না। শুধু প্রশিক্ষানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা যায় না। এর সঙ্গে মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজন।
সাক্ষরতা আর শিক্ষা এক কথা নয়। স্বাক্ষরতার হার শতভাগ হতে পারে। এরা কখনো শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নয়। কোনভাবে নাম দস্তখত লিখতে পারলে তাকে স্বাক্ষর বলে গণ্য করা হয়। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য এখানো নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আট সেপ্টেম্বর বিশ্বসাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। সাক্ষরতার হার নিয়ে আলোচনা হয়। যে কোন বয়সের মানুষ স্বাক্ষর শিখতে পারে। কিন্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষা একটা নির্দিষ্ট বয়সে অর্থাৎ শিশুকালে শুরু করতে হয়। শৈশব কৈশোরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করতে হয়। এজন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা যেন মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার পাসের হারের চেয়ে শিক্ষার মানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী