প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যায়। যাতে ব্যয় হয় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতে যায় ২৫ লাখ মানুষ (৯২%)। বাকি ২ লাখ মানুষ যায় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায়। সামান্য অংশ যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। যার মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী২১%, হৃদরোগী ১৮% এবং প্রজনন জটিলতার রুগি ১৩%। এর বাহিরে নাক, চোখ, কান, কিডনী, গ্যাস্ট্রোএন্টরোলজি, লিভার, অর্থোপেডিক ও স্নায়ুবিক চিকিৎসার জন্য ও যায় প্রচুর মানুষ।
সমপ্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক পিএইচডি গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর কত মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যায় এবং কত টাকা ব্যয় হয়, তার কোনও হিসাব নেই সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে। আট কারণে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যায় বাংলাদেশিরা। এগুলো হলো বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কম চিকিৎসা ব্যয়, সঠিক রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা, চিকিৎসা চলাকালে চিকিৎসাসহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা, মান সম্মত চিকিৎসা, রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় ব্যয়, চিকিৎসা পেতে কম সময় অপেক্ষা ও সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান।
বর্তমানে দেশে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে নিবন্ধনকৃত প্রায় সত্তর হাজার এমবিবিএস ডাক্তার সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যে কোনো দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার থাকা উচিত।বাংলাদেশে আছে প্রতি ২,৫০০ রুগির জন্য একজন ডাক্তার।জাতিসংঘের হিসাব মতে, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশসহ ৪৪% দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রয়োজনীয় ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে। তাই উন্নত বিশ্বের মত দেশে রেফারেল সিস্টেম চালু করা দরকার। এই ব্যবস্থায় ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থা ছাড়া যে কোনো অসুখের জন্য রোগীকে প্রথমে একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। এই ডাক্তারদের জেনারেল প্রাক্টিশনার বা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বলা হয়।এরা প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যদি মনে করেন রোগীর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহলেই কেবল রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান বা রেফার করেন। এতে জেনারেল প্রাক্টিশনাররা যেমন সাধারণ রোগী দেখার সুযোগ পাবেন, তেমনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও অপ্রয়োজনীয় রোগী দেখে সময় নষ্ট না করে জটিল রোগীদের অধিক মনোযোগ সহকারে দেখতে পারবেন।
এদিকে বর্তমানে দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে যে শতাধিক মেডিকেল কলেজ রয়েছে তার সবগুলোর শিক্ষার মান সমান নয়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর শিক্ষার মান তুলনামূলক ভালো হলেও এসব কলেজে রয়েছে নানান সমস্যা। বিশেষ করে অনেক নতুন কলেজে রয়েছে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অপ্রতুলতা। অধ্যাপক পর্যায়ের কোন শিক্ষককে নতুন প্রতিষ্ঠিত কলেজে বদলী করলে যেতে চান না। চাকরি ছেড়ে দেন তবুও নতুন কলেজে যান না তারা। আরো রয়েছে কলেজগুলোর অব কাঠামো সমস্যা ও ক্লিনিক্যাল অসুবিধা। এর মধ্যে কিছু মেডিকেল কলেজে রয়েছে রোগীর স্বল্পতা।
মেডিকেল শিক্ষায় লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক শিক্ষার গুরুত্ব সমান। হাতেকলমে শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষ থেকে ওয়ার্ডে রোগীর পাশে থাকতে হয়। কারণ শেষ সাড়ে তিন বছর মূলত ব্যবহারিক শিক্ষা। রোগীর কাছাকাছি না থাকলে এই শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক হতে গেলে রোগীর কাছে থেকেই শিখতে হয়। সেজন্য মেডিকেল শিক্ষায় হাসপাতাল একটি বড় অনুসর্গ। যে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জটিল ও রোগীর ভ্যারাইটি বেশি, সে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো ডাক্তার হিসাবে গড়ে উঠে। সেজন্য মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে হাসপাতাল থাকা জরুরি। কিন্তু কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের নেই কোনো নিজস্ব হাসপাতাল। হাতেকলমে শিখতে ও সান্ধ্যকালীন পাঠ নিতে শিক্ষার্থীদের যেতে হয় জেলা সদর হাসপাতালে। প্রতিদিন চারবার যাওয়া আসায় কমপক্ষে চার ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। আর এভাবেই চলছে গত বার বছর। কলেজ ও হাসপাতালের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। শুধু হাসপাতাল নয়, এই কলেজের আরো বড় সমস্যা হলো এখানে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নেই। জানা যায়, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে একজন অধ্যক্ষসহ শিক্ষকের পদ ৯৫টি। এর মধ্যে ৪২ শিক্ষকের পদ খালি। এখানে অধ্যাপকের পদ আছে ১৫টি, যার মধ্যে ১২টি খালি। কলেজে পড়ানোর কাজ চালাচ্ছেন মূলত প্রভাষকেরা। তাঁদের পদ আছে ২৫টি, আছেন ২১ জন।
দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩৭টি। প্রায় সব মেডিকেল কলেজে রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা।অথচ অভিজ্ঞ ও পর্যাপ্ত শিক্ষক ছাড়া যথাযথ পাঠদান ও পাঠগ্রহণ সম্ভব নয়। তাই যথাযথ পাঠগ্রহণ ছাড়াই প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন শেষ করে চিকিৎসকের পেশা শুরু করছেন।
মেডিকেল শিক্ষায় আটটি বিষয়কে মৌলিক বিষয় বা বেসিক সাবজেক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হচ্ছে অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা, শারীরবৃত্ত, প্রাণরসায়ন, কমিউনিটি মেডিসিন, ওষুধবিজ্ঞান, চিকিৎসা আইন, রোগবিদ্যা ও অণুজীববিজ্ঞান। মেডিকেল কলেজগুলোয় এই ৮টি মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কিউরেটর ও প্রভাষকের পদ আছে ২,০০৫টি।এর মধ্যে ৫৮৮টি পদে কোনো শিক্ষক নেই। শুধু তাই নয়, সারা দেশে চলছে অধ্যাপকের চরম সংকট। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপকের পদ আছে ২১৩টি, কাজ করছেন ৬৫ জন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে মেডিকেল শিক্ষায় সরকারি কলেজে মৌলিক ও ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৫,৯২০টি, শিক্ষক নেই ২,৪৫৯টি পদে। এর মধ্যে আটটি মৌলিক বিষয়ে ২৯% শিক্ষকের পদ খালি, অন্যান্য ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ৪৮% পদ খালি এবং সামগ্রিকভাবে ৪২% শিক্ষকের পদ খালি। জানা যায়, শিক্ষার্থী দের মৌলিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার আগ্রহ কম, পেশা চর্চার আগ্রহ বেশি। কারণ ক্লিনিক্যাল বিষয়ে সুনাম ও অর্থ দুটোই আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমস্যাটি বহু পুরোনো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদিচ্ছার অভাবে তা দূর হচ্ছে না। তারা বলেন, এসব বিষয়ে যাঁরা শিক্ষক হবেন, তাঁরা বাড়তি আর্থিক সুবিধাসহ কী প্রণোদনা পাবেন, তা ঘোষণা করতে হবে। তাঁরা যেন এই বার্তা পান যে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের প্রয়োজন বেশি। কারণ ওই আটটি বিষয় হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার ভিত্তি। ওইগুলো না জানলে, না বুঝলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া সম্ভব নয়। দেশে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সেবা দিতে হলে দক্ষ, অভিজ্ঞ, দায়িত্ববান ও আস্থাবান চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। কিন্তু শিক্ষক সংকট বজায় রেখে তা কখনো সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে ভালো, দক্ষ, পর্যাপ্ত ও আস্থাবান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে পারলে চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষের বিদেশ যাওয়া অনেকাংশে কমে যাবে। যাতে দেশের অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। তাই মেডিকেল শিক্ষার সার্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য দরকার সরকারের সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্ত ও এর যথাযথ প্রয়োগ।
লেখক: প্রাবন্ধিকও কলামিস্ট।