মানব পাচারের কারণে বিদেশে সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রম বাজার

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার | বৃহস্পতিবার , ৩১ জুলাই, ২০২৫ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানবপাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানবপাচার। মানব পাচারের ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। ভীতি ও ভালোবাসাএ দুটিকে ব্যবহার করে তারা এ ফাঁদটা তৈরি করেছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার বেড়েই চলেছে। অবৈধ মানব পাচারের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সুনাম। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজার। এই মানব পাচারের কারণে বিদেশে শুধু শ্রম বাজার নয় বিভিন্ন দেশে দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশীদের ভিসা প্রদান। এই অবৈধ মানব পাচারে যেমন পাচারকারীরা জড়িত তেমনি জড়িত বাংলাদেশের কিছু ট্রাভেল এজেন্সী, ইমিগ্রেশন বিভাগ, আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী যারা অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এই পাচারকারীদের সহযোগিতা করছে। এই পাচারকারীদের হাতে পড়ে অনেকেই যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়ছে। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরে ট্রলারের মাধ্যমে যারা ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেন। ইউএনএইচসিআর বলছে, সমুদ্রপথ দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেসব দেশের মানুষ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর হাজারো মানুষ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছেন। ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই মানব পাচারের শিকার হয়ে থাকে। এর পেছনে মূলত দায়ী ভালো চাকরির আশায় মানুষের বিদেশে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। ১৪ বছরের মেয়েদের ২১২৩ বছরের দেখিয়ে নিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দালাল চক্র মেয়েদের অধিক উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে বড় বড় শহরে অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত করছে। বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে মিথ্যা বিয়ের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশি নারীরা বিদেশে পাচারের শিকার হচ্ছেন। এ চক্র এখন এত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তাদের দমন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও ভারতের হোটেলগুলোয় অনেক বাংলাদেশি মেয়ে পাচারের শিকার হয়ে জোরপূর্বক অবৈধ কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। ঝুঁকি সম্পর্কে ভালো করে না জেনেই তারা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

মানুষ দেশের বাইরে যেতে চায় দেশে কাজের সুযোগের অভাব রয়েছে বলে। সব জায়গায়ই ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে অপরাধীচক্র প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। যৌন নিপীড়নের জন্য নারী ও মেয়েশিশু পাচার এখনো সবচেয়ে ব্যাপক ও ঘৃণিত মানবপাচার। একটি অপরাধী চক্র অভ্যন্তরীণ, আন্তসীমান্ত বা আন্তদেশীয় মানব পাচারে সক্রিয় রয়েছে, যার প্রধান শিকার কিশোরকিশোরী ও তরুণতরুণীরা। বিশ্ব জুড়ে মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের একতৃতীয়াংশ শিশু। এই হার গত ১৫ বছরে তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ বিশালসংখ্যক জনসংখ্যা কোনো না কোনোভাবে মানব পাচারের ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে।

২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই দিনটিকে বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘মানব পাচার একটি সংগঠিত অপরাধশোষণ বন্ধ করুন’। সুতরাং এই অপরাধকে নির্মূল করা রাষ্ট্র এবং সমাজের দায়িত্ব।

পাচার কখনো থেমে নেই, আগে একভাবে হতো, এখন অন্যভাবে হচ্ছে। ভালো একটা জীবনের স্বপ্নে অনেক কিছু বুঝতে না পেরে তারা পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে। অভিভাবকেরা লাভের কথা ভেবে ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করে না। তাদের বোঝাতে হবে, এর পরিবর্তে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে দক্ষ করে তুললে সে এর চেয়ে অনেক গুণ ফিরিয়ে দিতে পারবে। তাদের জন্য অনেকগুলো অপশন তৈরি করে অভিভাবকদের সে সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। মানব পাচার যে কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা আমাদের দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে হবে, ধারণ করতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করে দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে। পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ যেসব জনগোষ্ঠীর কথা আমরা বলছি, তাদের শুধু চিহ্নিত করলে চলবে না, বাজারমুখী দক্ষতা উন্নয়ন করে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। জলবায়ু সহনশীল জীবিকায়নের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি বেশির ভাগ সময় হয় না, হলেও তাতে দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্য করা যায়।

তাহলে পাচার প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী?

বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ অনুযায়ী সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবৎজীবন কারাদণ্ড এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অনেক সময় অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সাধারণ উভয় ধরনের মানুষেরই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সাধারণ মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ মাইগ্রেশন এবং ট্রাফিকিং আলাদা করে বোঝে। বাকিরা যে পাচার হচ্ছে তারা তা বুঝতেই পারে না। তার কাছে প্রবাসে যাওয়াটাই সব। কীভাবে গেল, সেটা মুখ্য নয়। আমরা তো সরকার চাইলে অভিবাসন প্রত্যাশীদেরও ট্র্র্যাক করতে পারেন তাতে বোঝা যাবে তিনি ঠিক জায়গায় যাচ্ছেন, নাকি তিনি পাচার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে আগে বোঝাতে হবে, কোনটা ‘প্রবাস’ আর কোনটা ‘পাচার’। বিদেশ যাওয়ার আগে তাদের বোঝাতে হবে এটা করা যাবে না, আগে জানো তুমি কোথায় যাচ্ছো, কেন যাচ্ছো। আইনে মানব পাচারের সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথা বলা আছে। কিন্তু লোকবল সংকটসহ নানা কারণে এটি করা যাচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছা আছে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। তাই মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন শাখা মানব পাচার নিয়ে কাজ করলেও সবার মধ্যে উপাত্ত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে পাচারবিরোধী খবর তুলে আনতে হবে। পাচারকারীরা প্রযুক্তিনির্ভর যেসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে, তা ব্যবহার করেই কাউন্টার ক্যাম্পেইন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সংবাদপত্রে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন বেশি করে প্রকাশিত হওয়া দরকার, যেগুলো ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগবে। এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য ছোট ছোট প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা যেতে পারে। সরকারের উচিৎ সম্ভাবনাময় অভিবাসীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করা এবং তাদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশ ত্যাগের আগে অভিবাসীদের আরও উন্নত ও প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যেও বিনিয়োগ করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দিনশেষে, এই অপরাধের প্রকৃতি বিচারে এবং পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বিবেচনায়, সরকারকে অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সুসংগঠিত মানব পাচার ও চোরাচালানের নেটওয়ার্কগুলোকে অকার্যকর করে এই অপরাধকে দমন করতে হবে। মানবপাচার প্রতিরোধ, ভুক্তভোগীকে সহায়তা এবং পাচারচক্রের সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে অবশ্যই জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কনভেনশান এবং মানবপাচার রোধকরণ, হ্রাসকরণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য প্রটোকলের বাস্তবায়ন। এই ভয়ঙ্কর অপরাধ প্রতিরোধ ও বন্ধে মানবপাচারের শিকারের ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ীই আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

আইএলওর ৪৭টি কনভেনশন এবং ১টি প্রটোকল রয়েছে যেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম আইন তথাপিও আইএলওর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, বিশ্বব্যাপী ২৮ মিলিয়ন মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত আছে। এবং তার অধিকাংশ কারণ ঐ সমস্ত শ্রমিকগুলো মানবপাচারের মাধ্যমে শ্রমে নিযুক্ত আছে। আমরা সব সময় সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলি সেখানেও যথাযথ সমন্বয়ের একটা অভাব পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও এনজিওগুলোকে এদিকে নজর দিতে হবে। তাদের অভিবাসন যাতে সহজ ও নিরাপদ হয় তার জন্য সরকারকে সকল ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবিশ্বস্ত উপদেশ
পরবর্তী নিবন্ধশিশুবয়সে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার