মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়

বিশ্বজিৎ বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

কিশোর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে সকল কারকে শূন্য বিভক্তির উদাহরণ দিতে গিয়ে বাংলা ব্যাকরণে পড়েছিলাম ‘গুরুজনে কর নতি’। সেই সব এখন সেকেলে। বর্তমান এই ঘোর কলির যুগে এসে প্রিন্ট মিডিয়া বলেন, ইলেট্রনিক মিডিয়া বলেন কিংবা সোস্যাল মিডিয়াতে যে সমস্ত খবরাখবরগুলো উঠে আসছে তা রীতিমত উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে মানব সমাজকে ভাবিয়ে তুলছে। কারণ আমরা যে সমস্ত পাঠক বিভিন্ন মিডিয়াতে খবরগুলো পড়ি কিংবা শুনি অমুক জায়গায় শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পড়িয়ে প্রশাসনের উপস্থিতিতে ঘোরানো হচ্ছে কিংবা তমুক শিক্ষককে ছাত্রদের দ্বারা লঞ্ছিত হতে হয়েছে অথবা অমুক শিক্ষককে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর যারা কিনা সমাজের ধারক-বাহক কিংবা সমাজের নীতি নিধারণী পর্যায়ে রয়েছেন তারাই এ পর্যন্ত দিতে পেরেছেন কিনা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানা নেই।

অথচ সমাজ সংস্কার করার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিভিন্ন চ্যানেলে দফায় দফায় প্রতিদিন টক শো করতে দেখা যায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সমাজ ব্যক্তিত্ব কিংবা সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের। তবে কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে কিংবা হচ্ছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা এ বয়সে এসেও ছোটবেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের এখনো দেখলে পায়ে ধরে সালাম করি, প্রণাম করি (অবশ্য যারা বেঁচে আছেন)।

এসব সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ আসে কিন্তু পারিবারিক শিক্ষা থেকে। আমার ধারণা সামাজিক অবক্ষয়ের আগে পারিবারিকভাবে একটা ছেলে কিংবা মেয়েকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, নীতিবোধ এসবের ধারনা দিতে হবে। আমার ছেলে কিংবা মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কি করছে এসব কিন্তু তার চলনে-বলনে বেরিয়ে আসে। এগুলো পরিবারের অভিভাবকরা লক্ষ করলে তার ছেলেমেয়ে খুব একটা বিপথে যাবার সুযোগ থাকে না। ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতার ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের কিছুটা ঘাটতি অবশ্যই রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমাদের গ্রামে ইন্দ্রজিৎ বাবু নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন। নিজে খুব একটা লেখাপড়া শেখেননি; কিন্তু আমরা যারা ছোট বেলায় গ্রামে বড় হয়েছি তাঁর অনুশাসন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। মাঝ বয়সে এসে এখনো চিন্তা করি সেই সব মানুষদের কথা; তাঁদের আন্তরিকতা, তাঁদের শাসনের কথা। একটা উদাহরণ দিলে আপনাদের হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। ছোটবেলায় ফুটবল খেলাটা একটা নেশার মত ছিল। পড়ন্ত বিকেলে যে যেখানেই থাকুক খেলার মাঠে কিন্তু উপস্থিত। তবে যে-ই সূর্য্য ডুবতো ঐ ইন্দ্রজিৎ বাবু একটা গাছের ডাল নিয়ে বড় পুকুর পাড় দিয়ে যখনই হেঁটে আসতে দেখলে সবাই যে যার মত করে ছুটোছুটি করে ঘরে ঢুকে পড়তো।

এই ছিল বড়দের প্রতি ছোটদের সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ এবং ভীতিবোধ। শুধু তাই নয়, ঊনি সন্ধ্যার পর বাড়ী বাড়ী গিয়ে পাহারা দিতেন সবাই পড়ালেখায় ব্যস্ত আছে কিনা। আজকাল সেই সব সমাজ সচেতন মানুষদের দেখা যায় না, পাওয়া যায় না তাঁদের সান্নিধ্য। যার ফলে সমাজ হয়ে পড়েছে অস্থির, বেপরোয়া, যার কুফল দেশের প্রতিটা নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলছে। এখন মানুষ হয়েছে আত্মকেন্দ্রিক। কিভাবে রাতারাতি টাকা বানিয়ে অর্থ-বিত্তশালী হওয়া যায়, চারটা গাড়ি, পাঁচটা বাড়ির মালিক হওয়া যায় সেই সব চিন্তায় এখন সবাই ব্যস্ত। পরিবারকে সময় দেয়ার সেই সুযোগ কই?

আর তাতেই পরিবারে ধরছে ফাটল, সমাজ হচ্ছে অস্থিত্বহীন। এই ধরুন রাস্তায় আপনি কোন বিপদে পড়েছেন, কেউ আপনাকে আক্রমণ করেছে, সবাই ঝামেলায় পড়ার ভয়ে আপনাকে রক্ষা করার জায়গায় তাড়াতাড়ি কেটে পড়বে। এইতো আমাদের মানবিক মূল্যবোধ। এখন যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছেন অযোগ্যদের তালিকায়। আর অর্থ বিলিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিরাই যোগ্যতার আসন দখল করে বসে আছেন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। চানক্ষ্যে পণ্ডিতের কথা আপনারা শুনেছেন নিশ্চয়ই। তিনিতো কয়েকশ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন ‘ঘোর কলিতে থাকবে না ভাই মানির মান’। কিংবা অঘাট-ঘাট, অজাত-জাত হবে।

সমাজে এসবের অবসান হবে যতদিন হবে না, ক্রমশই ততই বাড়বে অস্থিরতা, অপকর্ম এবং অরাজকতা। অবশ্য বর্তমানকালে কতিপয় শিক্ষকদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ অমুক রাজনীতির সাথে জড়িত আবার কেউ তোষামোদিতে সন্তুষ্ট। আবার অনেক শিক্ষক শিক্ষাবাণিজ্যে ব্যস্ত। অমুখ শিক্ষকের কাছে না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়া কিংবা ফেল করিয়া দেয়ার ঘটনাও পত্রিকা মারফত দেখা যায়। যার ফলে শিক্ষকরা পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছেন হরহামেশা।

সব মিলিয়ে একটা অবাস্তব, অকল্পনীয় এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির স্বীকার হচ্ছি আমরা যারা সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই সমাজে বসবাস করছি তারা। এই সমাজের মানুষের আন্তরিকতা বলতে কিছুই নেই, ধূর্তামি করে চলতে পারলেই তার পোয়াবারো। এসব থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ, সুন্দর, স্থিতিশীল সমাজ বিনির্মানে সচেতন সমস্ত নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে যার সুফল পাবে সমাজ, দেশ হবে সুন্দর; এ প্রত্যাশা সবার।

লেখক: সাংবাদিক এবং সংগীত শিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিনয় আমার প্রথম দুর্বলতা : আফজাল হোসেন
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৬.৪১ কোটি টাকা