প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে তিনটি– চাকরিজীবী সৃষ্টি করা; সংস্কৃতির ভদ্রলোক সৃষ্টি করা এবং বিবেকবান ও সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করা। হয়তো প্রথম উদ্দেশ্য অর্থাৎ চাকরিজীবী সৃষ্টি হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাকি দুটি পথ অর্জন যে সহজ নয় সেটা অনুমেয়। এদিকে ‘সংস্কৃতিচর্চা‘ কথাটি শুনলেই কেউ কেউ মনে করেন, গান–বাজনা, নাচ, কবিতা আবৃত্তি মানেই সংস্কৃতিচর্চা। তারা ভুলে যান, আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। মানুষ যা ভাবে, যা বলে, যা করে সবই তার সংস্কৃতির অংশ। একজন মানুষ, দু‘জন মানুষ, দশজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড দিয়ে যখন সমাজ এগিয়ে যায়, তখন সেটিই হয়ে ওঠে তাদের সংস্কৃতি।
অনেকে মনে করেন, শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিতে দুরূহ হয়ে পড়েছে। বন্ধ প্রকোষ্ঠে শিক্ষার্থীরা বন্দি। স্বল্প পরিসরে শিক্ষার্থীরা সীমাবদ্ধ থাকায় তাদের মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। তাদের শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে, এই বৈষম্য দূরীকরণে সরকারসহ সকলে সচেষ্ট। একইভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। আর এই বৈষম্য দূর করতে সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। সমাজে সাংস্কৃতিক চর্চা যত বৃদ্ধি পাবে, মানবিক সমাজ ততই পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংস্কৃতিবান হতে গেলে অবশ্যই জ্ঞানচর্চার সঙ্গে থাকতে হবে। দৃঢ় চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের হতে হবে। হতে হবে মূল্যবোধনির্ভর আত্মবিশ্বাসী ও নীতি–নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন। প্রতিটি প্রথা ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সম্যকভাবে জ্ঞান থাকতে হবে কলা ও মানবিকতার। সবচেয়ে বড় কথা, হৃদয়ের চর্চা করতে হবে। হৃদয়ের গভীর থেকেই অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা তৈরি হয়, যা সৃজন বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। হেগেল বলেছিলেন, ‘প্রচণ্ড আবেগ ভিন্ন কোনো মহৎ সৃষ্টি সম্ভব হয়নি কোনো কালে।‘
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতিটি সমাজ–সভ্যতা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। প্রতিটি পরিবর্তনের ফল ভোগ করছে আজকের আধুনিক প্রজন্ম। এই পরিবর্তনের কারণে যেমন তাদের ভালো–মন্দ অর্জন হচ্ছে, আবার কখনও এর ব্যতিক্রমও দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যে একটি বড় সংকট দেখা যাচ্ছে সেটি নিঃসন্দেহে কিশোর অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ অপরাধ? অপরাধী কারা? কেউ তো জন্ম থেকে অপরাধী হয় না। শিশু–কিশোরদের আমরা বলি, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, সেই শিশু–কিশোররাই পরে বিপথগামী হচ্ছে। এর পেছনের কারণ জানতে হলে প্রথমেই ভাবতে হবে, শিশুর সামাজিকীকরণ হচ্ছে কি–না সেটি দেখা। এর দায়িত্ব নিঃসন্দেহে পরিবার নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। শিশুটি বড় হয়ে কাদের সঙ্গে মিশছে, কারা তার বন্ধু এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের চলাফেরা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবশ্যই বাবা–মাকে খোঁজখবর রাখতে হবে। সেইসঙ্গে শিক্ষকদের ভূমিকা এখানে বেশ গুরম্নত্বপূর্ণ। পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে শিশু, কিশোর ও তরুণদের জীবনের একটি বড় অংশ কাটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায়। শিক্ষকদের ছায়ায়।
ডিজিটাল সংস্কৃতির যুগে ছোট–বড় সবার চোখ এখন মুঠোয় বন্দি। তথ্য বলুন আর বিনোদন– সবই হাতের কাছে। এক সময় বাবা–মায়েদের কাছে গল্প শুনতাম, স্কুল ছুটি শেষে তারা হাতে নাটাই–ঘুড়ি নিয়ে ছুটতেন। কখনও গাছে ঝুলে দোল খেতেন। এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা সেগুলো শুনলে চোখ বড় বড় করে তাকায়। তারপর মুখ গুঁজে দেয় ছোট পর্দায়। ইট–কাঠের শহরে অবশ্য এর বাইরে ভাবাও দুষ্কর বটে! এ ছাড়া যৌথ পরিবারে এক সময় সবাই মিলে খাওয়া, উৎসবের আয়োজন করা, একজনের সমস্যায় আরেকজনের এগিয়ে আসা ছিল পারিবারিক সংস্কৃতি। এখন অধিকাংশ পরিবারের নিজস্ব জগৎ আছে। বাচ্চা কাঁদলেই এখন তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুঠোফোন বা ট্যাব। আধুনিক পরিবারের এই জগৎ অনেক সময় এতটাই অন্তঃসারশূন্য যে সামনের মানুষটি চোখের সামনে কীভাবে বদলে গেল তা বোঝারও সময় হয়ে ওঠে না। তাই আমরা বুঝতে পারি না, গান ভালোবাসা ছেলেটা কবে থেকে গান শোনা বন্ধ করে দিল। কবেই বা কিছু দানব তার মনুষ্যত্ব দখল করে নিল। সুতরাং শিশুকিশোরদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জায়গায় কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব তাদের মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে কাজ করা। যেখানে সংস্কৃতি হতে পারে বড় নিয়ামক। সাংস্কৃতিক চর্চা হতে পারে বড় হাতিয়ার।