মানবিকতার বন্ধন ব্যতিরেকে সমাজ চলতে পারে না

| মঙ্গলবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

এক চরম নিষ্ঠুর অমানবিক ঘটনায় শিহরিত হয়ে উঠেছে নগরবাসী। ভাড়া নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়া হলো যাত্রীকে। কী ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর কাহিনি! গত ১৪ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে চলন্ত বাস থেকে যাত্রীকে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে নগরীতে। শুক্রবার রাত সোয়া ৯টার দিকে লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। যাত্রীকে ফেলে দিয়ে বাসটি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে বাসের চালক। কিন্তু অন্য যাত্রীরা টাইগারপাস এলাকায় বাসটি আটক করে। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। এ ঘটনায় বাসের চালক ও তার সহকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভুক্তভোগী যাত্রী বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
এ ধরনের ঘটনা আমাদের মর্মাহত করে। এটি স্পষ্টত মানবিকতাবিবর্জিত। মানবতাহীন এখনকার মানব সমাজের গন্তব্য কোথায় ভাবতে গেলে ভয় ও দুর্ভাবনায় পড়তে হয়। হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই দেখি না। নিকট অতীতে মানব জীবন নৈতিকতা ও মানবিকতাপূর্ণ ছিল, তা না বললেও এখনকার সময়ের মতো সমাজ থেকে এত ব্যাপকভাবে উধাও হয়ে যায়নি। এখন কারো মুখে নীতি কথা নেই। শোনার মানুষও নেই। সেবা দেয়ার বা সেবা নেয়ার সময় নেই মানুষের হাতে। মানুষ কেবল ছুটছে বিশাল চাহিদা নিয়ে। হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে অর্থ ও আধিপত্যের পেছনে অতৃপ্ত মনে, অশান্ত ও অস্থির হৃদয়ে। অল্পে সন্তুষ্ট থেকে সহজ-সরল, সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনে আমাদের অনীহা। আমরা যা পাই তার চেয়ে বেশি চাই অন্যদের বঞ্চিত করে হলেও। জীবন চলছে কেবল নিতান্ত স্বার্থপরতায়। আমরাভিত্তিক না হয়ে হয়েছে আমিভিত্তিক। আমার বৈষয়িক অর্জন যদি সমষ্টির কষ্টের কারণ হয় আমি তার ধার ধারি না। ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী জাকারিয়া চৌধুরী লিখেছেন, আমাদের অনৈতিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ডে পৃথিবী এখন বেসামাল। অর্থবিত্ত ও প্রতাপের মোহে আর সব করণীয় ভুলে মানুষ এখন ছন্দহারা, দিশাহারা। ফলে মানব মনে নেমে এসেছে শূন্যতা, হতাশা ও অস্থিরতা ও বিষণ্নতা। ‘শক্তি যার জীবন তার’ বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের এই তত্ত্ব প্রকৃতির নিয়ম ও পরিসরে প্রযোজ্য। মানব জাতির বেলায় এই নীতি মেনে নেওয়া মানে পশু জীবনে নেমে যাওয়া। মানব সভ্যতার উত্থান পতন এক চলমান প্রক্রিয়া। আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরানে বার বার উল্লেখ করেছেন মানব সমাজে যখনই নৈতিকতা, মানবিকতা ও স্রষ্টা-সচেতনতা লোপ পায় তখন তিনি সেই সভ্যতা ধ্বংস করে দেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে, যেমন- ঝড়, তুফান, খরা, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, মহামারী ইত্যাদি দিয়ে।
‘চোখ থাকিতে আমরা অন্ধ’ না আমি অন্ধ? ইতিহাস সম্পর্কে কার্ল মার্কস এর মতাদর্শন অনুযায়ী ইতিহাসের গতি পরিবর্তন হয় শ্রেণি সংগ্রামের দ্বন্দ্ব থেকে আল কোরানের বাণী অনুযায়ী ইতিহাসের পটপরিবর্তন ঘটে ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব থেকে। স্রষ্টা মানুষের মন সৃষ্টি করেছেন ন্যায়-অন্যায়ের, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিদ্বেষ ভালোবাসা প্রভৃতির দ্বন্দ্ব দিয়ে। বলা যেতে পারে ‘দৈবিক দ্বান্দ্বিকতা’ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। আমরা কোন পথে চলবো সেই স্বাধীনতা আছে আমাদের। পশু জীবনে এই সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষ চলে সচেতন মনে বেঁধে দেয়া সামাজিক নিয়মে। আর সেই ক্ষেত্রে আমরা ভুল করলে, সমাজ হয় অমানবিক ও অনৈতিক, বেশির ভাগ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহনীয়।
আমাদের মধ্যে মানবিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। সর্বক্ষণ আওড়াতে হবে মানবিকতার মূলমন্ত্র। যে মূলমন্ত্র হলো মানুষের কল্যাণ, জাতির কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ, সাংস্কৃতিক কল্যাণ। মোটকথা হলো মানুষের ভালোর জন্য কিছু করা, মানুষের উন্নতি সাধন করা। যে উন্নতি সাধনে রয়েছে একটি চর্চাশীল প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন পশু মানুষে পরিণত হয়। এবং সে পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া দেখে অন্যরাও আস্তে আস্তে মনুষ্যত্বে পরিণত হতে শিখে। আমাদের অঙ্গীকার হোক- আমরা যেন দানবিক থেকে মানবিক হয়ে উঠি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত উদ্ভাবনকে যেমন কাজে লাগাবো, তেমনি মানবিকতাকে জাগ্রত রাখবো। নৈতিকতা ও মানবিকতার বন্ধন ব্যতিরেকে সমাজ চলতে পারে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে