মানবাধিকার, শ্রমের মর্যাদা ও সহিংসতামুক্ত কর্মপরিবেশ প্রসঙ্গে

ফজলুল কবির মিন্টু | বুধবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসএকটি দিন, যা শুধু স্মরণ নয়; মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি কতটা দৃঢ় বা দুর্বল, তা পরিমাপের দিনও বটে। স্বাধীনতা, মর্যাদা, সমতা, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার প্রতি বৈশ্বিক অঙ্গীকারের এই দিনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আবার আলোচনায় এসেছে বিশ্বজুড়ে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিশ্বের ছয়টি শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থা বিগত অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেযা কেবল আনুষ্ঠানিক সতর্কতা নয়, বরং ভবিষ্যতের নৈতিক দায়িত্ব পালনের কঠোর আহ্বান। চিঠিতে বলা হয়েছেবিগত সরকারের সময়ে সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার, সাংবাদিক নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার থামাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি আমাদের সকলের জন্য সতর্ক সংকেত, একই সঙ্গে নতুন পথচলার রূপরেখা।

দুই.

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশের সামপ্রতিক ইতিহাসে বারবার ফিরে এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছেএ ধরনের অপরাধকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। র‌্যাবের মতো বাহিনীর সংস্কার বা পুনর্গঠনের কথাও এসেছে। ডিজিএফআইসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ক্ষমতার সীমা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বহু বছর ধরে এই একই দাবি জানিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এবার বার্তাটি এসেছে সহযোগিতার ভাষায়সত্য প্রকাশ ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না, আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে মানবাধিকার টেকসই হতে পারে না।

তিন.

মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল কারণ তিনটিক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহিতার অভাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চিঠিতে বলা হয়েছেস্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন আইন সংশোধন করতে হবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। কোনো সমাজ তখনই গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, যখন নাগরিকরা ভয় নয়অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে; যখন রাষ্ট্রের শক্তি নাগরিকের বিরুদ্ধে নয়তার কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।

চার. মানবাধিকার মানে শুধু রাজনৈতিক অধিকার নয়; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শ্রমঅধিকারও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, বাঁচার মতো মজুরি না পাওয়া, ইউনিয়ন গঠনে বাধা ও কর্মস্থলে ভয়ভীতির মুখোমুখি। শ্রমিকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং কর্মঘণ্টা, ছুটি ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার মতো মৌলিক শ্রম অধিকারের বাস্তবায়ন জরুরি। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৩২৫ অনুচ্ছেদ শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কোনো শ্রমিক যেন দারিদ্র্যের মধ্যে না পড়েএটাই মানবাধিকারের মৌলিক নীতি।

পাঁচ. কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা আজও বড় চ্যালেঞ্জ। যৌন হয়রানি, চরিত্রহনন, ক্ষমতার অপব্যবহার, বেতন বৈষম্যএসব সমস্যা বহু নারীর দৈনন্দিন কর্মজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বাংলাদেশে এখনো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন নেই। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হল্তেএমন আইনের প্রণয়ন, স্বাধীন তদন্তব্যবস্থা, কঠোর শাস্তির নিশ্চয়তা এবং সম্মানজনক কর্মপরিবেশ তৈরিঅবিলম্বে প্রয়োজন। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে শুধু মানবাধিকার রক্ষা নয়এটি টেকসই উন্নয়নেরও ভিত্তি।

ছয়. ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ঘোষণার তিনটি অনুচ্ছেদমানুষ মর্যাদায় সমান (অনুচ্ছেদ ১), জীবনস্বাধীনতানিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩), এবং নির্যাতন নিষিদ্ধ (অনুচ্ছেদ ৫)-নতুন বাংলাদেশ গড়ার নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়আমরা কি সত্যিই এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?

সাত. আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর খোলা চিঠিকে হেয় না করে এটিকে নতুন সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত। নতুন প্রশাসনিক কাঠামোর সামনে এখন ঐতিহাসিক দায়িত্বঅতীত ভুলের দায় স্বীকার করা, মানবাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ শুরু করা এবং নাগরিকদের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা। ইতিহাস প্রমাণ করেছেমানবাধিকারই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও শক্তির মূল ভিত্তি।

আট. মানবাধিকার দিবসে আমাদের দাবিআইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গুম ও নির্যাতনের বিচার, স্বাধীন গণমাধ্যম সংরক্ষণ, নারী ও শ্রমিকের নিরাপত্তা সুরক্ষা, কর্মস্থলে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন, এবং ন্যায্য মজুরি ও শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। এগুলো শুধু মানবাধিকারের আওতাই নয়এগুলো মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য শর্ত।

নয়. মানবাধিকার রক্ষা করলে রাষ্ট্র টিকে থাকে; লঙ্ঘন করলে দুর্বল হয়ে পড়ে। শ্রমিকের মর্যাদা, নারীর নিরাপত্তা এবং নাগরিকের অধিকার রক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর খোলা চিঠি যেমন সতর্কবার্তাতেমনি নতুন সূচনারও ইঙ্গিত। আমাদের অঙ্গীকার হোকবাংলাদেশ হবে এমন একটি মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি মানুষের জীবন, শ্রম ও মর্যাদা সমানভাবে সুরক্ষিত থাকবে এবং কেউ ভয় নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচর্যাপদ : বাংলার হাজার বছরের ভাষা, দর্শন ও আত্মপরিচয়ের প্রথম দরজা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, যেখানে আমার জন্ম