মানবাধিকার-বিষয়ক আইন সহায়তা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম

জেনে নিন আপনার যত অধিকার

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | শুক্রবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

প্রশ্ন : পুলিশ কখন কোন ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারে?
উত্তর : যখন কোনও পুলিশ অফিসারকে তদন্তের ভার দেওয়া হয় তখন সেই পুলিশ অফিসার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারে। এ-ধারায় তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে-কোনও ব্যক্তিকে ডেকে পাঠাতে পারেন, তাকে প্রশ্ন করতে পারেন এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার এমন কোনও প্রশ্ন করতে পারেন না, যেসব প্রশ্নে তাকে (ব্যক্তি) ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করার প্রবণতা থাকে। তবে জানার বিষয় হচ্ছে, স্বাক্ষ্য আইনের ২৫ ও ২৬ ধারা অনুসারে ১৬১ ধারায় পুলিশ কর্তৃক গৃহীত স্বীকারোক্তি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয় না।
প্রশ্ন: চার্জশিট কী?
উত্তর: মামলার তদন্তে যদি সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার জন্য যে-অভিযোগপত্র বা পুলিশি প্রতিবেদন দাখিল করে তাকে চার্জশিট বলা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় চার্জশিট হয়।
প্রশ্ন: ফাইনাল রিপোর্ট কী?
উত্তর: প্রাথমিক তদন্তে যদি সাক্ষী ও সাক্ষ্যপ্রমাণে অপরাধ প্রমাণিত না হয় তাহলে আসামিকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য সুপারিশ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে-রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে তাকে ফাইনাল রিপোর্ট বলা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় ফাইনাল রিপোর্ট হয়।
প্রশ্ন: চার্জশিট, ফাইনাল রিপোর্ট ও পুলিশ রিপোর্ট কী ?
উত্তর: আসামির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার এবং আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ-সম্বলিত পুলিশ রিপোর্টকে যথাক্রমে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট (ফাইনাল রিপোর্ট) বলা হয়। অভিযোগপত্র ও চূড়ান্ত রিপোর্ট-এই দুটো মিলেই তৈরি হয় পুলিশ রিপোর্ট। পুলিশ রিপোর্ট আদালতে সাবমিট করার পূর্বে পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত নেয়া সংগত ।
প্রশ্নঃ সত্যিকারের কোনও ঘটনায় পুলিশ ইচ্ছে করে ফাইনাল রিপোর্ট দিলে কী হবে?
উত্তরঃ পুলিশ চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করার পরও একই মামলায় নতুন করে অনুসন্ধান বা তদন্ত করার কোনও বাধা নেই। তদন্তকারী অফিসার কোনও বিশেষ মামলা তদন্ত করার পর চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিলের পরে কোনও নতুন তথ্য জ্ঞাত হলে একই ব্যক্তির বা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনি পরবর্তীকালে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেন। একইভাবে ম্যাজিস্ট্রেটও কোনও আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার পরে পুনরায় নতুন তথ্যের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে আনতে পারেন। তাছাড়াও পুলিশের ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ আদালতের মাধ্যমে নারাজি দরখাস্ত দিয়ে মামলায় নতুন করে তদন্ত করতে পারে।অথবা আদালতে সরাসরি অপরাধ আমলেও নিতে পারেন, মনে রাখতে হবে আইনের দৃষ্টিতে না-রাজি বা নতুন এজহার বা অভিযোগ ।
প্রশ্ন: ময়না তদন্ত বা পোস্টমোর্টেম রিপোর্ট কী?
উত্তর: স্বাভাবিক মৃত্যু নয়এই সন্দেহের উদ্রেক হলে, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয়ের জন্য ফরেনসিক বিভাগ বা হাসপাতাল কর্তৃক নির্ধারিত মৃতদেহের যে-পরীক্ষা করা হয় তাকে ময়না তদন্ত বা পোস্টমোর্টেম বলা হয়। ময়না তদন্তের জন্য চিকিৎসকের নিকট মৃতদেহ পাঠানো হলে চিকিৎসক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মৃতদেহ পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৭৬ ধারামতে।
প্রশ্ন: সুরতহাল বা ওহ-ছঁবংঃ জবঢ়ড়ৎঃ কী?
উত্তর: হত্যা, আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনার কারণে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে-এমন সংবাদ পেলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যাবেন। স্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তিকে যে-অবস্থায় দেখবেন, সেখানেই মৃত ব্যক্তির দেহে ক্ষত, ভাঙা বা মচকে যাওয়ার দাগ, আঁচড়ের দাগসহ অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন বর্ণনা করে এবং যে-অস্ত্র বা যন্ত্র দ্বারা উক্ত চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলে তাঁর (তদন্তকারী কর্মকর্তার) মনে হয় সেটা উল্লেখ করে আপাতদৃষ্টে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করবেন। এ-ধরনের রিপোর্টকে সুরতহাল রিপোর্ট বলা হয়। এই সুরতহাল রিপোর্ট খুব মূল্যবান দলিল। মৃত। ব্যক্তির শরীরে দৃশ্যমান সব আঘাতের কথা বা যে-অবস্থায় মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গিয়েছে তার বর্ণনা লেখা থাকে সুরতহাল রিপোর্টে। তবে পুলিশ হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে পুলিশ তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে পারবে না, করলে আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। সেক্ষেত্রে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেটের, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৭৬ ধারা মতে।
প্রশ্ন : ওকালতনামা কী?
উত্তর : বিচারপ্রার্থীর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীকে যে-লিখিত ফর্মের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয় তা-ই ওকালতনামা । সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতি থেকে ওকালতনামা সরবারাহ করা হয়।
প্রশ্ন : কেউ আত্মহত্যা করলে বা কারও অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে কী করা উচিত?
উত্তর : কেউ আত্মহত্যা করলে এবং কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে থানায় লিখিত আকারে জানাতে হবে এবং থানায় ইউডি (আনন্যাচারাল ডেথ বা অস্বাভাবিক মৃত্যু) মামলা দায়ের করতে হবে। আমরা জানি অনেকে এ-ধরনের ঘটনা ঘটলে লুকাতে চেষ্টা করে, তার ফলে তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের, তাই আমার পরামর্শ: এ-ধরনের ঘটনা ঘটলে প্রথমে পুলিশকে খবর দেওয়া এবং প্রতিবেশীদের ডেকে বিস্তারিত অবহিত করা। মনে রাখতে হবে, এ-সময় মৃত ব্যক্তিকে তার অবস্থান থেকে সরানো বা গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। কারণ আপনার হাতের ছাপ বা সরানোকে আইনের চোখে দোষী প্রমাণিত করতে পারে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারা অনুযায়ী অপমৃত্যু হলে পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী ও ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। ময়না তদন্ত ছাড়া দাফন/কাফন/সৎকার করতে চাইলে অবশ্যই এ.ডি.এম মহোদয়ের অনুমতি নিতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট, আইনজীবী ও সভাপতি, বাংলাদেশ হিউম্যন রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ, চট্টগ্রাম শাখা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৃন্ময়ী রূপী চিন্ময়ী সিবানী
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা