মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে

| শুক্রবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৭৩তম বার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিস শহরে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষার একটি সাধারণ মানদণ্ড নির্ধারণের লক্ষ্যে যে সনদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যে সনদকে বিশ্বব্যাপী বিবেচনা করা হয় মানবাধিকারের সুরক্ষা সনদ হিসেবে এবং এখন পর্যন্ত জাতিসংঘভুক্ত ১৯২টি দেশ এই সনদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
মানবাধিকার বলতে আমরা কী বুঝি? সাধারণ অর্থে বুঝি, মানুষের সে সকল অধিকার ও স্বাধীনতাকে যে অধিকারগুলো নারী, পুরুষ, শ্রেণী, ভাষা, জাতী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো মানুষ তার জন্য জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমানভাবে উপভোগ করতে পারে। মানবাধিকার একটি ধারণা যা উপলব্ধির বিষয়। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ এক লেখায় বলেছেন, সাধারণ মানবিক গুণাবলি সম্বলিত সব ব্যক্তির মর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার যে অধিকার তাই মানবাধিকার। এই অধিকার সব ব্যক্তির আচরণ এবং সামাজিক ব্যবস্থার ওপরে নৈতিক দায়িত্ব প্রদান করে। এ অধিকার সার্বজনীন, হস্তান্তর অযোগ্য ও অবিভেদ্য। মানবাধিকার সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং স্বাধীন ও মর্যাদা সম্পন্ন জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা মানুষ অন্যের নিকট থেকে, রাষ্ট্রের নিকট থেকে ন্যায্যভাবে দাবি করতে পারে, তাকে অধিকার বলা হয়। অধিকার বিভিন্ন রকমের। যেমন : ব্যক্তিগত অধিকার, নাগরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার ইত্যাদি। এসব অধিকার আইনের ভাষ্য অনুযায়ী বহুধা বিস্তৃত। কোথাও এই অধিকার এক প্রকার পাওনা। যেমন: চলাফেরা করার অধিকার। কোথাও এটি স্বাধীনতা। যেমন কবিতা লেখা কিংবা গান গাওয়ার অধিকার/স্বাধীনতা। কোথাও এ অধিকার ক্ষমতা; আবার কোথাওবা বিশেষ নিরাপত্তাকেও অধিকার বলা হয়। মানুষের যেমন অধিকার আছে তেমনি তার কর্তব্যও আছে। দেশের সংবিধান ও আইন, এই অধিকার ও কর্তব্যের সীমা দেয় এবং সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। দেওয়ানি আইন মানুষের অধিকার ও দায়িত্বের পরিধির বিধান দেয় এবং পরিধি অতিক্রান্ত হলে তার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে। মানুষ হবার কারণে বা জন্মসূত্রে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান। মানবাধিকার হলো এসব অধিকার ও মর্যাদার মূর্তিরূপ। তাই সহজে মানব অধিকার হলো মানুষের অধিকার। আর অধিকার হলো প্রতিটি মানুষের ন্যায্য পাওনা এবং তার বৈধ ক্ষমতার উপভোগ। মানুষ হবার কারণে প্রতিটি ব্যক্তির কিছু সহজাত বা স্বভাবজাত অধিকার রয়েছে, যা তার প্রাকৃতিক অধিকার। যেমন : জীবনধারণের অধিকার, কথা বলার অধিকার ইত্যাদি। কিছু কিছু অধিকার মানুষ নিজেই সার্বজনীনভাবে চিহ্নিত করেছে; এ অধিকারগুলো মানুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, যা তার আইনগত অধিকার। যেমন : ভোটদানের অধিকার, সংগঠন করার অধিকার ইত্যাদি। মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকার ও আইনগত অধিকারের সমষ্টিই হচ্ছে মানবাধিকার।
অনেকের প্রশ্ন জাগে, বাঁচার স্বাধীনতা, জীবন ধারণের স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমান সুযোগের অধিকার, যার যার ধর্ম পালনের অধিকার, ভাষার স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত হয়েছে? সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা থেকে মুক্তি কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে? সঙ্গে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই অধিকারগুলোও কি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে? এসব প্রশ্ন এখন অনেকের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা মানবাধিকার সনদে সম্মান জানিয়েছি জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকারকে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও স্বাধীনতা যথেষ্ট খর্ব হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের উপর অর্পিত কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
মানবাধিকার প্রকৃতপক্ষে একটি বোধের নাম, যে বোধ মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে শিক্ষা দেয় এবং অপরের মনুষ্য পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান করার দীক্ষায় দীক্ষিত করে। মানবাধিকার একটি সমাজে কতটা বিরাজ করছে, তার মাপকাঠি সমাজের একজন মানুষ নিজের জীবনটা কতটা নিশ্চিন্তে যাপন করতে পারছেন। তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, লৈঙ্গিক পরিচয় কিংবা বয়স তাঁর আত্মপরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে না-এই আশ্বাসে তাঁকে আশ্বস্ত থাকতে হবে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর জীবনটা তিনি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কোনো রকম হেনস্তা বা হয়রানির শিকার না হয়ে মোটামুটি শান্তিতে যাপন করে যেতে পারবেন। মানবাধিকার বলে, মানুষ হয়ে জন্মেছে বলেই কিছু অধিকার তার সহজাত। এসব অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না, সে কোনো ব্যক্তিই হোক, কি রাষ্ট্র, কি সমাজ। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের স্বাক্ষর রেখে থাকলেও মানবাধিকারের বিষয়ে যে উদাসীনতা ও অনগ্রসরতার উদাহরণ রেখেছে, তা খুব কম করে বললেও বলতে হয়, অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বমানবাধিকার দিবস