গত বছরের তুলনায় মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দুই ধাপ উপরে উঠে ১৩৩-এ দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রকাশের ছয় দিন পর ২১ ডিসেম্বর সকালে বাংলাদেশে প্রকাশ হওয়া দ্য নেঙট ফ্রন্টিয়ার : হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যানথ্রোপসিন শিরোনামে এই প্রতিবেদনে মানব অগ্রগতির উপর একটি নতুন পরীক্ষামূলক সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউএনডিপি-র হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট (এইচডিআর) ২০২০ এ বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে আওতাভুক্ত আটটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, তবে পৃথিবীর চাপ-সামঞ্জস্যিত মানব উন্নয়ন নতুন সূচকে (পিএইচডিআই) নয় নম্বরে উঠে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি করেছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এইচডিআই মূল্য ৬০.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ২০১৯ সালের এইচডিআই মাঝারি মানব উন্নয়ন গ্রুপের দেশগুলোর গড়ের চেয়ে বেশি।
১৯৯০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্মের আয়ুু ১৪ দশমিক ৪ বছর বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ বছরের পর বছর স্কুলে পড়াশোনা বৃদ্ধি পায় এবং স্কুলের কাঙ্ক্ষিত বয়স ৬ বছর বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের জিএনআই ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ২২০ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার আমাদের সম্পদ বাড়ানোর দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আর সম্পদ তখনই বাড়বে, যখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করা হবে। এই দুটি খাতে আগের চেয়ে বরাদ্দ বাড়লেও এখনো অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম আছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি দেশেই ধনবৈষম্য প্রকট। বাংলাদেশে ১০ শতাংশ ধনীর কাছে মোট সম্পদের ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ আছে, আর ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৩০ ও ২৯ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ১০ শতাংশ মানুষের কাছে যদি ২৬-২৭ শতাংশ সম্পদ থাকে, তাহলে যতই উন্নয়ন হোক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চিতই হতে থাকবে।
আমাদের শিক্ষা উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমপ্রতি বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকছে। কোনো কাজ পাচ্ছে না। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এ অবস্থায় মানবসম্পদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আশা করা যায় না।
সে ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন কৌশল বদলাতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, যেই উন্নয়ন ধনীকে আরও ধনী করে এবং গরিবের অবস্থান আরও দুর্বল করে, সেই উন্নয়ন প্রত্যাশিত নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের গৃহীত সব সরকারি কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দরিদ্র মানুষের হক নিয়ে কেউ নয়ছয় করে পার না পায়। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ কাজ পায়। উন্নয়নের রোল মডেলের দাবিদার দেশে এক-তৃতীয়াংশ বেকারের শিক্ষা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তবু সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য সরকারের প্রশংসা করতেই হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষা, দক্ষতা সৃষ্টি, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতে ভারত রীতিমত পিছিয়ে আছে। ২০১৫ সালের জন্য যে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারিত হয়েছিল, ভারতে তার অনেকগুলোতেই পিছিয়ে আছে, যেমন শিশুমৃত্যুর হার বা সাফাই ব্যবস্থার প্রসার। এ বিষয়ে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা দরকার। তিন বছরের মধ্যে শিক্ষা খাতে মোট সরকারি ব্যয় জিডিপি’র ৬ শতাংশে পৌঁছানো দরকার, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপি’র ৩ শতাংশে। দারিদ্র রেখার নীচে থাকা পরিবারগুলোর জন্য শিক্ষা ভাউচার প্রবর্তন করা যায়, এর ফলে স্কুলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং শিক্ষা অর্জনে উন্নতি ঘটবে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতিকে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং মানব উন্নয়নের দ্বৈত লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে এক দিকে বিনিয়োগ এবং ভোগব্যয় বাড়বে, অন্য দিকে মানবসম্পদের প্রসার ঘটবে। দুইয়ে মিলে আয়বৃদ্ধি উৎসাহিত হবে এবং তার ফলে মানুষের উন্নতির আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হবে। এই কর্মকাণ্ডে দেশীয় শিল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।