মানবপাচার-শ্রমিক নির্যাতন নির্ভর ফ্রান্সের শ্যাম্পেন শিল্প

| শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ফ্রান্সে ২০২৩ সালের আঙুর সংগ্রহ মৌসুমে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ শ্রমিক নিপীড়নের ঘটনায় রেইমস শহরে শুরু হয়েছে এক মানবপাচার মামলার বিচার। এই বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশটির শ্যাম্পেন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবপাচার ও শ্রমিক নির্যাতনের অজানা কথা গুলো এখন প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। খবর বাংলানিউজের।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসা ৫০ জনেরও বেশি অবৈধ মৌসুমি শ্রমিককে প্রতারণার মাধ্যমে আনা হয় এবং অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। মামলার প্রধান অভিযুক্ত স্‌েভতলানা জি. নামের এক কিরগিজ নারী, যিনি ‘আনাভিম’ নামে একটি শ্রমিক নিয়োগ সংস্থা পরিচালনা করতেন। তার সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছেন এক জর্জিয়ান পুরুষ ও একজন ফরাসি নাগরিক। এই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ্ত তারা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে প্যারিসে বসবাসকারী পশ্চিম আফ্রিকান সোনিনক সমপ্রদায়ের সদস্যদের ‘ভালো বেতনের চাকরি’র লোভ দেখিয়ে আঙুর সংগ্রহের কাজে নিয়োগ দেন। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকদের জন্য অপেক্ষা করছিল নির্মম বাস্তবতা। ১৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সী এসব পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের রাখা হয়েছিল একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে, যেখানে ছিল না পরিষ্কার পানি, শৌচাগার বা পর্যাপ্ত খাবার। গাদাগাদি করে বিছানাবিহীন ঘরে মেঝেতে মাদুর পেতে রাত কাটাতেন তারা। খাবার বলতে একবাটি ভাত আর পচা স্যান্ডউইচ এই ছিল তাদের দৈনিক রেশন। শ্রমিকদের একজন, ৪৪ বছর বয়সী কানুয়িতিয়ে জাকারিয়া, স্থানীয় পত্রিকা লা ক্রোয়াকে বলেন, আমাদের রুশ ভাষায় গালাগালি করতো, আর যে বাড়িতে রাখা হয়েছিল সেখানে পশুও থাকতে চাইবে না। ৪৫ বছর বয়সী ডুম্বিয়া মামাদু জানান, এই অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই ভয়াবহ। আমরা এখনও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, অথচ কাগজপত্র না থাকায় কোনো সহায়তাও পাচ্ছি না।

একজন স্থানীয় বাসিন্দার সন্দেহে পুলিশ ও শ্রম পরিদর্শকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রমাণ সংগ্রহ করে। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আনিক ব্রাউন বলেন, ওখানে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা সবকিছুই মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। তদন্তে জানা যায়, শ্রমিকদের দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজ করানো হতো, মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে। কোনো লিখিত চুক্তি ছিল না, যাতায়াত হতো ট্রাকের পেছনে ঠাসাঠাসি করে। পারিশ্রমিকও ছিল বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি বেমানান।

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অবৈধ শ্রমিক নিয়োগ, অঘোষিত শ্রম এবং অনুপযুক্ত বাসস্থান প্রদানের মতো একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। এই মামলাটি ফ্রান্সের বহুল আলোচিত শ্যাম্পেন শিল্পে শ্রমিক নিপীড়নের চিত্র সামনে এনে দিয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মৌসুমি শ্রমিক হাতে তুলেই আঙুর সংগ্রহ করে, যা এই ৬ বিলিয়ন ইউরোর বাজারের মূল ভিত্তি। কিন্তু ২০২৩ সালে প্রচণ্ড গরমে শুধু শ্যাম্পেন ও বোজোলেই অঞ্চলে ছয়জন শ্রমিকের মৃত্যু এই চিত্রকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বলছে, অনেক বড় শ্যাম্পেন কোম্পানি মধ্যস্থতাকারীদের ব্যবহার করে অবৈধ শ্রমিক নিয়োগের দায় এড়িয়ে যায়। তারা আইন পরিবর্তনের দাবি তুলেছে, যাতে কোনো প্রডিউসার পরোক্ষভাবেও ‘অবৈধ শ্রম’ ব্যবহার করলে তাদের শ্যাম্পেন লেবেল বাতিল করা যায়। অন্যদিকে, শ্যাম্পেন উৎপাদকদের শীর্ষ সংস্থা ‘শ্যাম্পেন কমিটি’ জানিয়েছে, এই ধরনের ঘটনার হার খুবই কম এবং ধরা পড়লেই তা বন্ধ করা হয়। তবে এই মামলায় তারা নিজেও পক্ষভুক্ত হয়েছে, কারণ এমন অনৈতিক ঘটনার প্রভাবে ব্র্যান্ডের যে ক্ষতি হয়েছে, তা তারা অস্বীকার করতে পারছে না। এই বিচার কেবল তিনজন অভিযুক্তের নয় এটি ফ্রান্সের বিলাসবহুল পানীয়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা শ্রমিক নিপীড়নের মুখোশ উন্মোচনের দিকেও এক দৃষ্টি ফেরানো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতাইওয়ান প্রণালীতে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের টহলে চীনের প্রতিবাদ
পরবর্তী নিবন্ধপ্যারিসে ইসরায়েলি অস্ত্র প্রদর্শনীতে নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক টানাপোড়েন