তিন হাজার মানুষের বড় একটি টিম নিয়ে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রায় সাড়ে বারোশ’ মানুষের লাশ পরিবহন এবং দাফন করলেও তাদের একজন কর্মীও করোনায় আক্রান্ত হননি। শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীই নন, হিন্দু এবং বৌদ্ধ মিলে ১৬ জন অমুসলিমকেও সমাহিত করেছে গাউসিয়া কমিটি। করোনায় আক্রান্তদের লাশ দাফন কাফনে যখন অতি প্রিয়জনও পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা পরম মমতায় একের পর এক লাশ দাফন করেছেন। আত্মার আত্মীয় হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। জানাজার নামাজ পড়িয়ে দাফন কাফন করেছেন বহু অভাগা মানুষকে। লাশ দাফন কাফনের পাশাপাশি কারো প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স এবং অক্সিজেন সেবা দিয়েও গাউসিয়া কমিটি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সারাদেশে লক্ষাধিক পরিবারকে দিয়েছে খাদ্য সহায়তাও। করোনাকালের ভয়াল সময়ে অনন্য এক মানবিক সংগঠন হিসেবে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ মানবতাকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
করোনায় আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া পিতা মাতার লাশ যখন সন্তান দাফন করছিল না, লাশে হাত লাগাচ্ছিল না, গোছল দেয়াতে রাজি হচ্ছিল না; মায়ের লাশ জঙ্গলে ফেলে সন্তানের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা যখন মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছিল; সেই ভয়াল সময়ে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওইসব মানুষের দাফন কাফনে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। গত ১৫ মার্চ গাউসিয়া কমিটির পক্ষ থেকে এই আগ্রহের কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদেরকে সিভিল সার্জনের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়। ২৪ মার্চ গাউসিয়া কমিটি সিভিল সার্জনের সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের আগ্রহের কথা জানায়। ২৯ মার্চ বিষয়টি নিয়ে সিভিল সার্জনের সাথে বৈঠক বসেন তারা। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়। ১৩ এপ্রিল পটিয়ার হাইদগাঁওয়ে করোনায় মারা যাওয়া প্রতিবন্ধী এক শিশুর দাফন কাফনের মাধ্যমে শুরু হয় গাউসিয়া কমিটির লাশ দাফন কাফনের কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের শুরুতে কিছুটা ভয় থাকলেও গত ১ মে মোহরা এলাকায় করোনায় মারা যাওয়া নুরুল আফসারের দাফন কাফনের সময় সংগঠনের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব পেয়ার মোহাম্মদ কমিশনার এবং যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার অংশ নেয়ায় পুরো কার্যক্রমে নতুন এক গতির সঞ্চার হয়। এরপর থেকে আর কাউকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা। প্রতিটি উপজেলা ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও টিম গঠন করে গাউসিয়া কমিটি করোনায় মারা যাওয়া কিংবা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের লাশ গোছল করিয়েছে। পরিবহন করেছে। দাফন করেছে।
সাম্প্রতিক হিসেবে করোনায় আক্রান্ত এবং করোনায় উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া চট্টগ্রামের ৯৫৮ জনসহ সারাদেশে ১২৩৩ জন মানুষের লাশ দাফন করেছে গাউসিয়া কমিটি। এরমধ্যে ১৬ জন অমুসলিম। গাউসিয়া কমিটির তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবকের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম এই বিপুল সংখ্যক লাশ দাফন কাফনের কার্যক্রমে জড়িত। গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গাউসিয়া কমিটি লাশ পরিবহন এবং দাফন কাফনের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের একজন সদস্যও করোনায় আক্রান্ত হননি। লাশ পরিবহনের পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত রোগীসহ অসংখ্য অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে আনা নেয়ায় অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও দেয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের জন্য কারো কাছ থেকে এক টাকার ভাড়াও নেয়া হয়নি। বহু লাশ দাফনের সময় কাফনের কাপড়ের যোগানও গাউসিয়া কমিটি দিয়েছে।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, করোনাকালে আমাদেরকে যারা ডেকেছেন তাদের পাশেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। একেকদিন ৩/৪টি লাশও দাফন করা হয়েছে। অমুসলিমদের লাশও আমরা পরম যত্নে পরিবহন করে সৎকারের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের চেষ্টা এবং আন্তরিকতা ছিল। বহু ব্যক্তি এবং সংগঠন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু আমরা উজাড় করে মানবতাকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি।
গাউসিয়া কমিটির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব পেয়ার মোহাম্মদ কমিশনার দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, আমাদের তিন হাজার সদস্যের বিশাল একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম শহর বন্দর গ্রামে কাজ করছে। আমাদের সদস্যরা পরম মমতায় লাশ পরিবহন এবং দাফন কাফন করিয়েছেন। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার কৃপায় আমাদের একজন সদস্যও করোনায় আক্রান্ত হননি। বিষয়টিকে তিনি পরম করুণাময়ের বিশেষ রহমত বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যদি আমাদের সদস্যদের করোনা আক্রান্তের ঘটনা ঘটতো তাহলে আমাদের এই মিশন সফল করা অনেক কঠিন হতো। শুধু করোনাকালেই নয়, ভবিষ্যতেও লাশ দাফন কাফন এবং রোগী পরিবহনের মতো কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।