উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা। আয়তনে আমেরিকা থেকেও অনেক বড়। টরন্টো ওন্টাঁরিও প্রদেশের রাজধানী। টরন্টোকে কমার্শিয়াল সিটি বলা হয়। আজ হতে ৮ বছর আগে ২০১৪ সালে ৪ঠা জুলাই আন্তর্জাতিক লায়ন ক্লাবস কর্তৃক আয়োজিত ৯৭তম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক কানাডার টরন্টো শহরে গিয়েছিলাম। ওন্টাঁরিও হৃদের পাড়ে টরন্টো শহর। ওন্টাঁরিও হৃদের কাছে ছোট মেয়ের বাসা। তাই হ্রদটা দেখার সুযোগ হয়েছিল হ্রদ নয় যেন সাগর। বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। সেইবার আমি ৪র্থ বার চেষ্টা করে কানাডার ভিসা পাই। ১ম ২য় ও ৩য় বার যখন ভিসা পেতে ব্যর্থ হই, আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। ৪র্থবার ভিসা পেয়ে যাই। সুতরাং সবার উদ্দেশ্যে বলি যে কোন কাজে লেগে থাকলে সুফল অবশ্যই পাওয়া যায়। এটা তার দৃষ্টান্ত। ২রা জুলাই তার্কীস এয়ারলাইনে ইস্তাম্বুল হয়ে টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছে স্থানীয় সময় বিকাল ৫-১৫ মি:।
ইমিগ্রেশনে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। ইমিগ্রেশন শেষ করে বাহির হতেই একটু দূরে আমার বড় ছেলে, বৌমা, নাতিরা সবাই আমাদের নিতে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে যে রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম ওটা হাইওয়ে এক্সপ্রেস রোড-৪০১, ব্যস্ততম রোড পিঁপড়ার জাঁকের মত গাড়ী চলছে। কোন হর্ণ নেই শুধু গাড়ির শব্দ। কারণ হর্ণ বাজানো দণ্ডনীয় অপরাধ। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আসলো- বিশৃঙ্খল মাতৃভূমি থেকে সুশৃঙ্খল একটা দেশে আসলাম। সময়ের ব্যবধান তাই গাড়ীর ভেতর ঘুম পাচ্ছিল। যেহেতু আন্তর্জাতিক লায়ন্স সম্মেলনে আমার আসা- তাই একটু বলে রাখি ১৯১৭ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে এক জীবনবীমা কর্মী নাম- “মেলভেন জোনস” বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক লায়ন্স স্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত ও দূর্দশাগ্রস্থ লোকদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। ছেলের বাসা ছিল ডাউন টাউন থেকে ২০ কি.মি. দূরে এগলিংটন-স্কারব্যুরো। বাড়ীর চারিদিকে বিশাল বিশাল বৃক্ষ যেন ছায়া ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেন। ডাউন টাউনে যেতে বাস/ট্রেইন দুটোতে যাওয়া যায়। টরন্টো শহর বেশ ছিমছাম, প্রশস্ত রাস্তা শহরের বাহিরে পথচারী তেমন একটা দেখা যায়না। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের দেশে পথ চলতে ধাক্কা খেতে হয়। কানাডার লোকসংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৪ কোটির উপরে। তাই সরকারীভাবে জনবহুল বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে সামার বা বসন্তকাল।
শীত যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গাছে গাছে সবুজ পাতা ও ফুলে ফুলে ভরে উঠে। অথচ কয়েকদিন আগেও সব গাছ শুধু ডালপালা ছিল। সবাই বলে সামার / বসন্তকাল এসেছে তবে কোকিলের ডাক শুনা যায়না। এ সামারেও টরন্টোতে দেখলাম ক্ষণস্থায়ী বর্ষার তান্ডব। হঠাৎ কালোমেখে আকাশ ছেয়ে গেছে। সাথে সাথে বৃষ্টি এমনকি শিলাবৃষ্টিও। ওরা বলে সামারের পরেই শীত আসলে সমস্ত প্রকৃতি বরফে ঢাকা পড়ে যায়। এটা আরেকটা রূপ। দেখলাম সামারে পুরুষরা প্রায়ই হাফ প্যান্ট পড়ে থাকে। সামারে বাংলাদেশী প্রবাসীরা যাদের একটু জায়গা আছে শাকসবজির বাগান করে। প্রকৃতির এমন খেলা খুব দ্রুত এগুলো বেড়ে যায়। আমার ছেলের বাড়ীর পিছনে বেশ বড় জায়গা। তাতে আমি ঢেরস, শশা, জুগিনি, লাল শাকের বাগান করছিলাম। খুব খেয়েছি।
সুশাসনের দেশ কানাডা। সর্বস্তরে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিয়ম কানুন প্রতিটা নাগরিক কঠোরভাবে মেনে চলে। সে কর্মস্থলে বলুন, শপিং মলে বলুন, রাস্তায়, গাড়িতে যেমন আশে পাশে গাড়ি না থাকলেও সিগনাল না পড়া পর্যন্ত গাড়ী চলবেনা। ব্যক্তি জীবনেও কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। কর্মস্থলে অনিয়ম করুন বিনা নোটিশে ফাইয়ার (বরখাস্ত) করে দেবে। যেকোন অভিযোগে পুলিশে ৯১১নং ফোন করুন যেমনটা ইদানিং আমাদের দেশেও হয়েছে ৯৯৯ নং। এখানে নাগরিকদের পুরো পরিবারের বৃত্তান্ত কম্পিউটারে সেট করা থাকে। ঐ দেশে অপরাধ করে কেহ পার পায়না। আমার অবস্থানকালে দেড় মাসে একবারও বিদ্যুৎ ফেল করেনি। চলার পথে ট্রেনে বা সাবওয়েতে চড়তে গেলে কিছু শিক্ষণীয় লেখা গাড়ির ভেতর চোখে পড়ে। মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে লেখা। যেমন- “you may be requested to vacate the seats for persons in wheel chair” Be safe and consider passenger, “Do not lean against the door” “Please do not block door way”, “Emergency alarm – press for assistance” “Missuse of emergency alarm is punishable” রাস্তার মোড়ের ট্রাফিক volunteer এর জামার পিছনে লিখা আছে “ASK Me” আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। সুতরাং এক কথায় তারাই সভ্যজাতি। আপনি যেখানে সেখানে রাস্তা পার হবেন, গাড়ি দাঁড় করাবেন বা যাত্রী উঠাবেন। ৫০-১০০ ডলার বা তারও বেশী ফাইন দিতে হবে। ভুল পার্কিং করবেন টিকেট ধরিয়ে দেবে। ডাউন টাউনে রথযাত্রা চলছিল। আমি সস্ত্রীক ডাউন টাউনে রথযাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বিশ্বের দীর্ঘতম রাস্তা “youne street” দিয়ে জগন্নাথের রথ টানা হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা তাতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। শহর থেকে আড়াই ঘন্টার পথ পৃথিবীর ৮ম আশ্চর্যের একটি কানাডার প্রধান আকর্ষণ “নায়াগ্রা জলপ্রপাত” দেখতে গেলাম। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা হৃদের পানি আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে প্রচণ্ড শব্দে বহু নীচে পতিত হচ্ছে। ঘর্ষণে তার থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আবার সেই পানি নদী হয়ে হ্রদে মিশছে। আমরা ষ্টিমারে করে ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট পড়ে একদম কাছে গিয়ে দেখলাম, জলরাশির ধোঁয়ার মাঝে রংধুন দেখলাম। অদ্ভুত মনে হল। নায়াগ্রার পাড়ে আমার ছোট মেয়ে সেইবার কেক কেটে আমার জন্মদিন পালন করলো। ডাউন টাউনের অদূরে একটা দ্বীপে সেন্ট্রাল পার্ক ভ্রমণ শেষে এন.সি.সি টাওয়ারে (উচ্চতা ১৮০১৫ ফুট) উঠেছিলাম। এখানে মার্কেটিং সিষ্টেম খুব আরামদায়ক ও সুশৃঙ্খল, তবে শপিং করার নামে চুরি করলে রক্ষা নেই। তখন আমি প্রায়দিন শপিংমলে যেতাম, কাছেই ছিল। ১০ ডলার বাজার করলে ঝুড়ি ভরে যেত। খাওয়া দাওয়া ও জীবনধারণের জন্য খুবই উপযোগী। এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মধ্যেও আমি মাছি দেখেছি তবে মশা দেখিনি। সর্বত্রই কাঠের ব্যবহার দেখেছি তবে বাঁশ দেখিনি। এখানে ছাগলকে বেবিগোট বলা হয় সরকারের কঠোর নির্দেশ ও দণ্ডনীয় অপরাধ ছাগলকে খাশি বানানো যাবেনা। আপনার যদি খুব তাড়া থাকে এবং কফি খেতে চান তবে টিমহর্টনের পিছনে গিয়ে গাড়ী থেকে না নেমে বোর্ডে অর্ডার করুন সাথে সাথে কফি চলে আসবে।
রাতের টরন্টো আরও চাকচিক্যে ভরা। মিশিসাগা টরন্টোর পরিকল্পিত ছোট্ট আধুনিক একটা শহর। অনেক বাংলাদেশী থাকে। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের ভোগ্য পণ্য এখানে পাওয়া যায়, তবে ইলিশের সাইজ বেশ বড় এবং সুস্বাদু।
মানবতার দেশ কানাডা- বয়স্ক ও শারীরিক চলাচলে অক্ষম নাগরিকদের জন্য সরকারের অনেক সাপোর্ট আছে। যেমন Old Home, Nursing Home, Rehabilitation Centre, বেবীদের জন্য, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য ইত্যাদি। চিকিৎসায় ও গবেষণায় কানাডা অনেক এগিয়ে। দেখেছি বাসে, ট্রেনে আপনাকে বহনকারী ট্রলি সাথে নিয়ে যেতে পারবেন। একমাত্র ইমারজেন্সী ছাড়া রুটিন রোগীরা চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হয়। বিপরীতে আমাদের দেশে যেকোন সময় যেকোন জায়গায় চিকিৎসা পাওয়া যায়। একদিন সস্ত্রীক ডাউন টাউনে বেড়াতে যাব, সাবওয়ে ট্রেনে যাচ্ছি। কয়েক ষ্টেশন যাওয়ার পর বলা হল ট্রেন আর যাবেনা। আপনারা বাসে যাবেন। বাস থেকে নেমে উপরে উঠে দেখি সারিবদ্ধভবে বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাসে চলতে চলতে একটা স্টেশনে থামল। এক গর্ভবতী মহিলা তার দুই বাচ্চা দুই ট্রলিতে, বাসে উঠবে, বাসের সামনের ড্রাইভারের অংশটা নীচু হয়ে গেল, একটা প্ল্যাটফর্ম অটোমেটিক বাস থেকে বের হয়ে ফুটপাতের সাথে মিশে গেল। ভদ্র মহিলা ও তার দুই সন্তান অনায়াসে বাস উঠে গেল। ড্রাইভার ট্রলি দুটো ভাঁজ করে রেখে দিল। সিট থেকে দুজন লোক উঠে গিয়ে তাদের বসতে দিল। একবার ভাবুন আমাদের দেশে কোনকালে এটা সম্ভব হবে? একবার আমার স্ত্রী রাস্তা দিয়ে হাটছিলেন আর কাশতেছিলেন। পাশে এক তরুন তাকে জিজ্ঞেস করল ‘Are you o.k’ এগুলি মানবতা। এটাই ধর্ম। কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা সহাস্যে উত্তর দেয়। বিরক্তিবোধ এদের নেই। কানাডা বিশ্বের অন্যতম Social Welfare Country, এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ফ্রি, তার উপর একটা বয়স পর্যন্ত ভাতা দেওয়া হয়। আপনি চলতে পারেন না আপনি মেশিন চালিত ট্রলিতে করে শপিং মলের ভেতরে গিয়ে বাজার করতে পারেন। এরা কুকুরকে নিজের ছেলে মেয়ের মত আদর ও লালন পালন করে। শুনেছি এমনকি কুকুরের হার্টে পেস মেকার বসানো হয়েছে। টরন্টো নগরীতে হিন্দু, মুসলিম মিলে হাজার হাজার বাংলাদেশী আছে। তাদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া ও চাকরি করছে। টরন্টোতে বাঙালি প্রবাসীদের বেশ কয়েকটা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। পয়সা দিতে হয়না। যেহেতু মাল্টি কালচারাল দেশ হিন্দু, মুসলিম সবাই স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম ভালভাবে উদযাপন করে। টরন্টো থাকাকালে অভ্যাসমত প্রতিদিন প্রাথভ্রমণে বের হতাম, অপূর্ব পরিবেশ, মৃদুমন্দ হাওয়া, মন ছুঁয়ে যেত, ইচ্ছে হয়েছিল থেকে যাই।
লেখক : প্রাক্তন চীফ এ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।










