নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে পালিত হচ্ছে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গাপূজা। বাঙালি অধ্যুষিত লাভাপিয়েসে আলাদা দু’টি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পাঁচ দিনব্যাপী এই দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) দুর্গোৎসব শেষ হবে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ এ ধর্মীয় উৎসবে বাংলাদেশী ছাড়াও নেপাল ও ভারতের পশ্চিম বাংলার অনেক প্রবাসীও অংশ নিচ্ছেন। এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে মাদ্রিদের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা লাভাপিয়েসের পাশে খেসুস ই মারিয়া রোডস্থ বাংলাদেশ এসোসিয়েশন হলরুমে ও কায়ে লাফে রোডের দু’টি হলে আলাদা দু’টি পূজামণ্ডপ তৈরি করা হয়।
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ পূজামণ্ডপগুলো আরাধনার পাশাপাশি ছিল মিলনমেলার ক্ষেত্রও। আরও দু’টি স্থানে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেছেন মাদ্রিদে বসবাসরত বাংলাদেশী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ঢাক-ঢোল ও শঙ্খ বাজিয়ে চলছে উলুধ্বনি। দুর্গাপূজাকে ঘিরে মাদ্রিদে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা যেন পরিণত হয়েছে উৎসবের নগরীতে।
গত বুধবার শেষ হয়েছে অষ্টমী পূজা। বৃহস্পতিবার ভক্তি আর শ্রদ্ধায় বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে আরতি, অঞ্জলি প্রদান ও প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে নবমী পূজা। এ দিন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রধান আকর্ষণ ছিল আরতি প্রতিযোগিতা। রাতকে উজ্জ্বল করে ভক্তরা মেতে ওঠেন নানা ঢঙে আরতি নিবেদনে। একই সঙ্গে দিনভর চলে চণ্ডীপাঠ। ছিল ভক্তদের কীর্তন বন্দনা। আজ মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। দশভুজা দুর্গার আরাধনার পাশাপাশি দেবীকে বিদায় জানানোর আয়োজনে ভক্তকুল থাকবেন বিষণ্ণ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের মিলনায়তনে আয়োজিত পুজো সমস্ত তিথি নির্ঘণ্ট মেনে পালন করা হয়।
অন্যান্যবারের মতো এবারও ছিল নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সব বয়সের মানুষই সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন এই অনুষ্ঠানে। আর এই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন এখানকার বয়োজ্যেষ্ঠরা। পুজোকে ঘিরে বিরাট আয়োজন হলেও কোথাও যেন একটা ঘরোয়া ছোঁয়া থাকে। আয়োজন করা হয় ভোগেরও। হাসিমুখে গোটা আয়োজনের দায়িত্ব ভাগ করে নেন সকলে। এরই সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডায় মেতে ওঠেন সবাই। দেশ থেকে অনেক দূরে সারাটা বছর জুড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা থাকেন নানা কাজে ব্যস্ত।
শুধু এই সময়টাতেই একসঙ্গে মেতে ওঠেন এখানকার বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সব কাজ ভুলে সবাই মেতে ওঠেন আনন্দে। তারপর ফিরে যাওয়া আবার সেই দৈনন্দিন জীবনে। স্পেনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আসেন এই পুজোতে।
মাদ্রিদ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক বিকাশ চক্রবর্তী উৎসবমুখর পরিবেশে প্রবাসে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন করতে পেরে খুবই উৎফুল্ল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
গত ১৪ অক্টোবর বিকেলে পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেছেন স্পেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সারওয়ার মাহমুদ।
পরিদর্শনকালে তিনি সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশকে একটি অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এ বছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তিনি প্রধানমন্ত্রীর উক্তি “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আবহমান কাল থেকে বাংলার মুসলমান-হিন্দু সম্প্রদায় এক বৃন্তে দু’টি ফুলের মতো যে নজির স্থাপন করে চলেছে দেশে বর্তমানে কিছু দুষ্ট চক্র সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর পাঁয়তারা করছে। আমাদের সকলকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।”
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের দুতালয় প্রধান এটিএম আব্দুর রউফ মণ্ডল।
সর্বজনীন দুর্গাপূজা পরিষদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে ফুলের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
এ সময় বাংলাদেশ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের মধ্যে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ইন স্পেনের সভাপতি কাজী এনায়েতুল করিম তারেক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেনের সাবেক সভাপতি ও স্পেন আওয়ামীলীগের সভাপতি এস আর আই এস রবিন, সাধারণ সম্পাদক মো. রিজভী আলম, সহ-সভাপতি একরামুজ্জামান কিরণ, তোতা কাজী, নারায়ণগঞ্জ জেলা এসোসিয়েশন ইন স্পেনের সহ-সভাপতি আবুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক খসরু হাসান প্রমুখ।
স্পেনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী সঞ্জয় ভর্মাও ১৩ অক্টোবর সকালে মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন দুর্গাপূজা পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, “দশমীই মূলত দুর্গাপূজার প্রধান অনুষঙ্গ। তবে দেবী দুর্গার বিদায় অর্থাৎ স্বামী গৃহে গমনের পাঁচ দিন পরই লক্ষ্মীপূজার মধ্য দিয়ে আবার পিতৃগৃহে ফিরে আসবেন। মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি যেমন কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেওয়াই বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য।”
ভারতের রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই সুন্দর পূজা আয়োজনের প্রশংসা করেন।
এ সময় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ইন স্পেনের সাবেক সভাপতি ও স্পেন আওয়ামীলীগের সভাপতি এস আর আই এস রবিন, সহ-সভাপতি একরামুজ্জামান কিরণ, সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক বিকাশ চক্রবর্তী, উত্তম মিত্র, মান্না চক্রবর্তী, শ্যামল তালুকদার, গৌরিক প্রভাত চক্রবর্তী, শ্যামল দেব নাথ, শংকর রায়, আপন মন্ডল, সুমন শীল, শংকর পোদ্দার, জুয়েল বদ্ধ, জয় সাহা, দিলীপ সূত্র ধর,উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ফুলের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
মাদ্রিদ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, “দেশের মতো আনন্দঘন পরিবেশ না থাকলেও এখানে আমরা নিজেদের মধ্যেই এ উৎসবকে ভাগাভাগি করে নিই।”
পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের হলরুমে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের জন্য গান পরিবেশন করেন প্রবাসী শিল্পীরা।