মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়ে থাকে। মাদকের পাচার বন্ধে এবং ব্যবহার ক্রমশ কমানোর জন্য এ দিবসের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ এক সময় পরিণত হয়েছিল এশিয়ার অন্যতম মাদক–সংকুল ও পাচারের কেন্দ্রে থাকা দেশে। মাদকের করালগ্রাসে যখন যুবসমাজের একাংশ বিপন্ন, তখন এ ব্যাপারে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর ভূমিকা পালন করা জরুরি ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার এবিষয়ে উদ্যোগী হয়ে দায়িত্বসম্পন্নতার পরিচয় দিয়েছে।
মাদক সমস্যা তথা মাদক দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও চোরাচালান সমস্যা দেশ–কাল, ধর্ম–বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। ধনী–দরিদ্র, উন্নত–উন্নয়নশীল কোন দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। মাদককে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত–দ্বন্দ্ব, কলহ, দুর্ঘটনা, ধ্বংস ও মৃত্যুর যে খেলা চলছে তাকে নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন যথা– স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তাই মাদক ব্যবসায়ী, মাদক বহনকারী ও মাদকসেবী–সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ইয়াবার মতো মাদক মানুষকে ধ্বংস করছে, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ককে নষ্ট করছে।
আইনজীবীসহ অনেকের অভিযোগ, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানেন, মাদক ব্যবসা কাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের ধরা হয় না। ধরা পড়ে চুনোপুঁটি, যারা পরিবহন বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। এছাড়া আদালতে বিচারের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত না হলে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এর কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মাদক পেলে মাদকসেবীর শাস্তি হতে পারে। তবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সচেতন মানুষ আশা করছে, এখন যেহেতু নতুন আইন হয়েছে, মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
মাদকের আগ্রাসন থেকে দেশ, সমাজ ও তারুণ্যকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে মাদক বিরোধী মানববন্ধন করা যেতে পারে। এতে ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড–এ মাদক বিরোধী স্লোগান বর্ণিত থাকবে। ‘মাদকমুক্ত সমাজ আমাদের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশব্যাপী মাদক বিরোধী লিফলেট বিতরণ করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক বিরোধী প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে হবে। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাদক বিরোধী পরামর্শ ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে।
সারা দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সঠিক সংখ্যা কত আমরা জানি না। খোদ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছেই মাদকাসক্তির সঠিক হিসাব নেই। কিন্তু আমাদের জানা আছে, মাদকাসক্তির কারণে সারা দেশের শহরে ও গ্রামে অনেক পরিবারে গুরুতর বিপর্যয় নেমে এসেছে। সন্তানের মাদকাসক্তির কারণে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে অনেক নারী খুন হচ্ছেন, অনেকে নিয়মিত নির্যাতিত হচ্ছেন। মাদকাসক্তির কারণে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটা অংশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। পারিবারিক অশান্তি ও সহিংসতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ মাদকাসক্তির বৃদ্ধি। তাই দেশে এখন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি যুদ্ধ প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।
মাদকের ব্যবহার ও পাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধের বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবন থেকে মাদকদ্রব্য উৎখাত এবং মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি পরিবারপ্রধানকে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। পারিবারিক অনুশাসন, নৈতিক মূল্যবোধ ও সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে।