মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মানুষ খুব খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এই ব্যাপারটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। কিন্তু যখন পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হয় তখন ব্যাপারটা কী ঘটে? তখন পরিবারের মনে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কী হলো, কী করা যায়, কিভাবে তাকে মাদকমুক্ত করা যায় এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়।
পৃথিবীতে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার একমাত্র জায়গা হচ্ছে রিহ্যাব সেন্টার। এটি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অবশ্যই তাকে যেকোনো নিরাময় কেন্দ্রের আওতায় আনতে হবে সুস্থ করার লক্ষ্যে। কিন্তু নিরাময় কেন্দ্রে দেওয়ার আগে পরিবারের প্রথম কথা হয়–আমাদের পরিবারের মান–ইজ্জত আছে, সবার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না, বাসা থেকে নেয়া যাবে না, মানুষ দেখবে। কিন্তু এতদিন নেশা করেছে, তখন কি মান–সম্মান নষ্ট হয়নি? মানুষ কি তখন দেখেনি? সবশেষে পরিবারের মতামতের ভিত্তিতেই রিহ্যাবে ভর্তি করানো হয়।
চট্টগ্রামে লক্ষাধিক মাদকাসক্ত রোগী রয়েছে, রোগীর তুলনায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র খুবই কম আছে। বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রে ১০ বেডে ২০/২২ জন, ২০ বেডে ৩০/৩২ জন রোগী ভর্তি নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো সেন্টারে রোগী পূর্ণ থাকা অবস্থায় একজন রোগীর মা–বাবা এসে যদি বলেন– “আমার ছেলে আমাদের গায়ে হাত তুলছে, ভাঙচুর করছে, আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, দয়া করে এখনই এসে নিয়ে যান”–সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? আমরা কি একটি পরিবারের এইসব কথা শুনে ফিরিয়ে দিতে পারবো? প্রশ্ন আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। যারা বলছেন অনুমতির চেয়ে রোগী বেশি, সে ক্ষেত্রে নিরাময় কেন্দ্রের করণীয় কী্তআপনারাই বলুন আপনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ব্যাপারে অনেকেই বাজে মন্তব্য করেন। একটি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করতে কত কষ্ট হয় সেটি কেবল একজন নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ই জানেন। সমাজে উচ্চ শ্রেণীর অনেক ব্যক্তি আছেন যারা চাইলে নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসেননি। অথচ বলার সময় অনেকেই অনেক কথা বলেন। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি প্রতিদিনই হয় তার পরিবারে, নয়তো আত্মীয়দের বাড়িতে, আবার কখনো রাস্তাঘাটে কোনো না কোনো অপরাধ করে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম মেট্রো জোনের আওতায় মোট ১৩টি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। যদি ধরি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৩০/৩২ জন রোগী আছে, তাহলে এই ১৩টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০০ জন মাদকাসক্ত রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। তাহলে কি দাঁড়ালো না, এই ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রতিদিন ৪০০টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কিংবা অপরাধজনিত ঘটনা প্রতিরোধ করা হচ্ছে? এর মাধ্যমে আমরা কি দেশের জন্য কিছু করছি না? আমাদের নিরাময় কেন্দ্র গুলোর কারণে প্রতিদিন ৪০০ টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা অপরাধ ঘটছে না।
আমাদের নিয়ে খারাপ কিছু লেখার আগে আপনাদের কি এসব নিয়ে ভাবনা আসে না? কিছু বিবেচনা করেন না? অনেক সময় রোগীর অভিভাবক বলেন-“আমার ছেলের আত্মহত্যার প্রবণতা আছে। হাতে ছুরি পেলে নিজের ক্ষতি করতে পারে বা আপনাদের ক্ষতি করতে পারে। ভাঙচুর করতে পারে। যদি পালানোর সুযোগ পায় তবে আমাদের মেরেও ফেলতে পারে।” এতকিছু বিশ্লেষণ করেও আমরা সেইসব রোগীকে ভর্তি নিই তাদের পরিবারের কথা ভেবে। নিরাময় কেন্দ্রে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্িষত ঘটনা ঘটে যায়। দীর্ঘদিন নেশা করতে করতে অনেক রোগী স্ট্রোক করে হাসপাতালে নিতে নিতে মারা যায়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় সকল দোষ নিরাময় কেন্দ্রের উপর চাপিয়ে দিতে চান অনেকেই। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র কি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কেউ মারা যাবে না? হাসপাতাল, গাড়ি বা রাস্তায় প্রতিদিন কেউ না কেউ স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। জন্ম–মৃত্যু সবই আল্লাহ্র হাতে।
প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্র ভিজিট করলে আপনি সহজেই খুঁজে পাবেন ২/১ জন ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছে। যার সম্পূর্ণ খরচ নিরাময় কেন্দ্রই বহন করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ সেইসব রোগীর ভরণ–পোষণের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেনি। ২০০০ সাল থেকে চট্টগ্রামে রিহ্যাব চিকিৎসা চালু হয়। ২০০৭ সালে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আমাদের নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনেন এবং কিছু নীতিমালা মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নির্দেশ দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকটি সেন্টার প্রতি মাসে ভিজিট করেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদারকির কারণে আগের চেয়ে এখন আরও উন্নত এবং ভালো চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য প্রত্যেকটি সেন্টারে ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর, ইকোট্রেইনার, পর্যাপ্ত স্টাফ, ভলেন্টিয়ার ও ওয়ার্ডবয় রয়েছে। চিকিৎসার মান আরও উন্নত করতে প্রতিনিয়তই কাজ করা হচ্ছে। নিউট্রিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের মানও উন্নত হয়েছে। এ ধরনের দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ জানাই। সব নিরাময় কেন্দ্র যদি রোগী নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তবে চট্টগ্রাম শহরের কী হবে? আমাদের নিয়ে কিছু লেখার আগে প্রথমে দেশের কথা ভেবে লিখবেন। কারণ সব নিরাময় কেন্দ্র রোগী সুস্থ করার পাশাপাশি সমাজকে বিভিন্ন অপরাধ থেকে রক্ষা করে সুন্দর সমাজ তৈরি করে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের ভুলগুলো নিয়ে সমালোচনা না করে আমাদের পরামর্শ দিন।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক
হেল্প মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র