মাদকাসক্তি নাকি মাদকনির্ভরতা

মো. শাহরিয়ার হোসেন শিমুল | বুধবার , ৪ জুন, ২০২৫ at ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমাজে মাদকবিরোধী সচেতনতার ঢেউ প্রতিদিনই শক্তিশালী হচ্ছে। গণমাধ্যম, দেয়ালিকা, বক্তৃতা ্তসর্বত্রই উচ্চারিত হয় একটি শব্দ : মাদকাসক্তি। কিন্তু চিকিৎসকদের রিপোর্টে কিংবা ইদানীংকালে পুনর্বাসন কেন্দ্রের রেজিস্ট্রারে দেখা যায় আরেক শব্দ : মাদকনির্ভরতা। প্রশ্ন জাগে কোনটি সঠিক? কিংবা আদৌ কি এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে?

শব্দের গল্প, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য

মাদকাসক্তি’ শব্দটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কথ্যভাষায়, গণমাধ্যমে এবং সাহিত্যচর্চায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি এমন এক মানসিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি, যেখানে একজন ব্যক্তি মাদক গ্রহণে এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে যে তার চিন্তা, আবেগ, আচরণ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। সমাজে একে দেখা হয় একটি নৈতিক দুর্বলতা বা বিপথগামিতার প্রতীক হিসেবে। অন্যদিকে, ‘মাদকনির্ভরতা’ শব্দটি এসেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা থেকে। এটি বোঝায়, যখন একজন ব্যক্তি শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েএমনভাবে যে মাদক ছাড়া তার শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান একে একটি নিরাময়যোগ্য রোগ হিসেবে দেখে।

একটি বাস্তব চিত্র

ঢাকার একটি ড্রাগ রিহ্যাব সেন্টারের পরামর্শদাতা চিকিৎসক বলেন, আমরা মাদকনির্ভরতাকে একটি ক্রনিক ডিজিজ হিসেবে দেখি। এটি উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতোইনিয়ন্ত্রণযোগ্য, তবে অবহেলা করলে ভয়াবহ হতে পারে।

অন্যদিকে একজন সমাজকর্মী জানালেন, ‘মাদকাসক্তি শব্দটি জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। এটি দিয়ে আমরা সচেতনতা গড়ে তুলতে পারি।’

ভাষা কি শুধুই শব্দ?

এখানেই আসে মূল প্রশ্নটি ভাষা কি শুধুই শব্দের খেলা, না কি এটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন? যখন আমরা ‘মাদকাসক্ত’ বলি, তখন অনেক সময় আমরা ব্যক্তি নয়, বরং তার আচরণকে দোষারোপ করি। কিন্তু যদি বলি ‘মাদকনির্ভর ব্যক্তি’, তখন তার প্রতি করুণা ও সহমর্মিতা তৈরি হয়। এই পার্থক্য শুধু ভাষার নয় এটি নির্ধারণ করে আমাদের নীতিমালা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, এমনকি সমাজের আচরণও।

তাহলে কোনটি ব্যবহার করবো?

সচেতনতামূলক কার্যক্রম, নাটক বা পত্রিকায় : ‘মাদকাসক্তি’ শব্দটি এখনো কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য। চিকিৎসা, পুনর্বাসন, এবং গবেষণাভিত্তিক কাজে: “মাদকনির্ভরতাশব্দটি অধিক যথাযথ এবং বিজ্ঞানসম্মত। সমন্বিত উপস্থাপনায় : দুটি শব্দ একত্রে ব্যবহার করলে বোঝাপড়াও হয় পরিষ্কার, যেমন– ‘মাদকনির্ভরতা বা মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি সম্ভব সঠিক সহায়তায়।’ শুধু মাদকের বিরুদ্ধে নয়, ভুল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও লড়াই জরুরি। মাদকের শিকার ব্যক্তিকে যদি আমরা শুধুই “আসক্ত” হিসেবে দেখি, তবে তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি কমে যায়। কিন্তু তাকে যদি “নির্ভরশীল ও চিকিৎসাযোগ্য একজন মানুষ” হিসেবে দেখি, তবে তার প্রতি সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ অনেকগুণ বাড়ে। ভাষা, এখানে শুধু প্রকাশ নয় এটি একটি দায়বদ্ধতার হাতিয়ার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাসু চ্যাটার্জী : চলচ্চিত্র পরিচালক
পরবর্তী নিবন্ধকোরবানির সামাজিকায়ন