মাদকবিরোধী গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন

| রবিবার , ২৭ জুন, ২০২১ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

গতকাল ছিলো মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। মাদক দ্রব্যের অপপ্রয়োগ ও তার অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে প্রতি বছর ২৬ শে জুন এ দিবস পালন করা হয়। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দ্বারা এটি প্রথম উদযাপিত হয়। জাতিসংঘের অফিস অন ও ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) বিশ্ব মাদক রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী, বিশ্বের এক বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (অথবা বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৫.৩%) ২০১৫ সালে অন্তত একবার হলেও মাদক সেবন করেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২৯.৫ মিলিয়ন মানুষ- বা বিশ্বের প্রাপ্তবয়স্কদের ০.৬ শতাংশ মাদক সেবনজনিত রোগে ভুগছে।
মাদকের অপপ্রয়োগ এই বিশ্বে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এইড্‌স, হেপাটাইটিস, যক্ষ্মার মত মারাত্মক রোগের পাশাপাশি মাদক সেবনের বহুবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন- আর্থিক ক্ষতি, অসামাজিক আচরণ, হিংস্রতা ও অপরাধ। বলা যেতে পারে, এটি সমাজের অধ:পতন ডেকে আনে। বিশ্ব মাদক সমস্যার মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ রীতিনীতি, মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা এবং বহতা উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সমাধান প্রদানের জন্য ফৌজদারী বিচার, স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিষেবাদির সমষ্টিগত ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়োজন।
মাদক চক্রগুলি সাধারণত আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু কিছু কিছু দেশ মাদক পাচারের ক্ষেত্রে ট্রান্স-শিপমেন্ট কেন্দ্রে অবস্থান করে। ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত এমন জায়গায় অবস্থান করে, যেখান থেকে সহজে মাদক আদানপ্রদান এবং ব্যবহার করা যায়। পশ্চিমের দেশগুলির সংস্কৃতির অনুকরণ, পারিবারিক গঠনের পরিবর্তন ও সঙ্গীদের চাপ, মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশে প্রকৃত মাদকাসক্তের সংখ্যা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি (৫০ লাখ)। এর মধ্যে ৮০ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ৪০ লাখই তরুণ। এই বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে।
মাদক প্রতিরোধে সরকারের কার্যক্রম প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, তিনভাবে মাদক প্রতিরোধ কার্যক্রম চলছে। একটি অপারেশনাল, যার মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের গ্রেফতার করে কোর্টে সোপর্দ করা হয়। আরেকটি হলো উদ্বুদ্ধুকরণ, যার মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে চিকিৎসা। মাদকের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
প্রতি জেলায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থাকা উচিত এমন মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ৪০ বেড থেকে ৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। এটি ২৫০ বেডে উন্নীত করার কাজ চলছে। মাদকাসক্ত এই জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। ধনী-দরিদ্র, দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে কেউ মাদকের করাল গ্রাস থেকে নিরাপদ নয়। উদ্বেগের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তির প্রধান শিকার আমাদের যুবসমাজ যা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল হুমকিস্বরূপ। কারণ যুবসমাজ জাতির প্রাণশক্তি এবং উন্নয়নের প্রধান কারিগর। যুবসমাজকে মাদকের ছোবল থেকে বাঁচাতে হলে পরিবারসহ সমাজকে উদ্যোগ নিতে হবে। উঠতি বয়সী সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে কি না তা অভিভাবকদের সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে। হতাশা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। তাই হতাশা রোধে যুবসমাজের জন্য নিয়মিত লেখাপড়া, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সমপ্রসারণ জরুরি বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মাদকের অবাধ বিস্তার রোধে মাদকবিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি মাদক নিরোধ-শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদক দেশের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের একটি বড় অন্তরায়। মাদকের কারণে এদেশে প্রতিনিয়ত বহু পরিবার ধ্বংস হচ্ছে; অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। মাদকের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি মাদকবিরোধী ব্যাপক গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালন এই আন্দোলনেরই একটি অংশ। কোন একক সংস্থার পক্ষে মাদকবিরোধী সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য দলমতনির্বিশেষে দেশের সকল মানুষকে এই আন্দোলনে শামিল হতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে