চীনা লোককাহিনির বিখ্যাত লেখক মো ইয়ান। যিনি ২০১২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত সৃষ্টি কর্ম উপন্যাস ‘সর্ঘাম’। যা চীনের মান্দারিন ভাষায় রচিত। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত এই উপ্যনাসে তিনি চীনের পূর্বাঞ্চলে নিজের এলাকার ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে কৃষকদের উপর নির্মম সহিংসতার বিবরণ তুলে ধরেন। তাঁর উপন্যাসের গল্প অবলম্বনে পরে চলচ্চিত্র তৈরি করেন বিখ্যাত চীনা নির্মাতা ঝ্যাং ইমু। তাও ছিল চীনের মান্দারিন ভাষায়। মো ইয়ানের প্রতিটি রচনা, যেমন -‘বিগ ব্রেষ্ট অ্যান্ড ওয়াইড হিপস’, ‘রিপাবলিক অব ওয়াইন’ এবং ‘লাইফ অ্যান্ড ডেথ’সহ সমপ্রতি বিখ্যাত আরেক টি উপন্যাস ‘ফ্রগ’ সবই তাঁর মাতৃভাষায় লেখা। তিনি তার নোবেল ভাষণের এক জাগায় বলেছিলেন, ‘আমি আমার মাতৃভাষায় উপন্যাস লিখি এবং উচ্চতর গবেষণা করি। কারণ মাতৃভাষা আমার কাছে হৃদয়ের ভাষা ও আমার সাধনার দেবী স্বরূপ। যে ভাষায় আমি আমার ছোটবেলার পাতা কুড়ানি মাকে দেখি। তাই আমার মাতৃভাষাই আমার সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম’। মো ইয়ানের লেখা চীনের লোক কাহিনি নির্ভর জনপ্রিয় প্রতিটি উপন্যাস ইংরেজি ভাষাসহ প্রায় ১২/১৩ টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। মাতৃভাষায় লেখালেখি তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়াতে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। মাতৃভাষায় লিখেও তিনি বৈশ্বিক জগতের সেরা লেখকের মর্যাদা পেয়েছেন। কারণ চীনের রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকার জানে, মাতৃভাষায় উচ্চতর জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ছাড়া জাতীয় ও বৈশ্বিক জগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বেশি তো দূরে নয়, নিজ মহাদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। দেখবেন সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের সাফল্য। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন নামের রাষ্ট্রগুলো তাদের সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে লালন, ধারণ ও প্রতিষ্ঠিত করে বৈশ্বিক উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে অগ্রসরমান।
আমাদের এই বিশ্বে আনুমানিক সাত হাজার ভাষার মধ্যে মাত্র ২৫টি ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে বাংলা ভাষা একটি।১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপ দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। পিতার ভাষা দর্শনে অনুসারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টা ও উদ্দ্যোগ একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো।কিন্তু ইতিহাস বলে সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের অগ্রগতির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয় নিরন্তর। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ইংল্যান্ডে সবর্স্তরে ইংরেজি ভাষা প্রচলনের কথা। কবি জিওফ্রে চসারের আগে ইংল্যান্ডের রাজকীয় ভাষা ছিল ফরাসি। ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি ফরাসি ভাষায় কথাবার্তা বলে আভিজাত্যের গৌরব অনুভব করত। কবি চসার প্রথম ফরাসি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংরেজ কবিরা ফরাসি ছেড়ে স্বদেশী ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন। এভাবেই ইংরেজি ভাষা হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের সর্বস্তরের মানুষের ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষাকেও এ পথেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়া নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট। দক্ষিণ কোরিয়া তার যাত্রা শুরু করে নিজের মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে। পাঁচ কোটি মানুষের এই দেশটি বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে মাতৃভাষায় রূপান্তর করে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষেণার প্রতিটি ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রচলন করতে সমর্থ হয়। এর ফলে জ্ঞানচর্চা ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে থাকে দেশটি–পরিণত হয় শিল্পোন্নত দেশে। আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রাণভোমরা হলো গণিত। গণিতের উৎকর্ষে দক্ষিণ কোরিয়া এখন সপ্তম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরিতে বিনিয়োগ না করে গবেষণা, উদ্ভাবন ও শিল্পের উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। নিজেদের উৎকর্ষ সাধনে জ্ঞান–বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের পথে হাঁটে। জাপানিরা সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারে যত্নবান ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৩৭ বর্গমাইলের আয়তনের সাড়ে ১২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটি পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার তাদের নিজ ভাষায় রূপান্তর করেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি লোকের বাস। সারা বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিপুল। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা কোনো অসম্ভব কাজ ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনা ও বিনিয়োগের। জ্ঞান–বিজ্ঞানের নতুন নতুন বই লেখার, বাইরের বিশ্বে যা লেখা হচ্ছে সেগুলো অনুবাদ করার। কাজটা প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে শুরুই হয়নি। যেজন্য বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনীতি। ভাষার একটি অর্থনীতি আছে। মধ্যবিত্তের একাংশ নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্ত আরও নিচে নেমেছে, প্রান্তিক কৃষক পরিণত হয়েছে ভূমিহীনে, ভূমিহীন হয়ে পড়েছে ভিটাহীন। এসব কিছুই ঘটেছে উন্নতির অন্তরালে। বস্তুত উন্নতির প্রবল চাপের কারণেই। এই বিপুল সংখ্যক দরিদ্র্য মানুষের জীবনে কোন ভাষা নেই। এরকম একটা অবস্থায় সর্বস্তরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় মাতৃভাষার প্রয়োগ জারি রাখা কতদূর সম্ভব? তা ভাববার অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ও সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪ –১৯৭১) ‘রাষ্ট্র ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে ( পৃষ্টা :৭৯) দেখা যায়, ‘বৃিটশ সরকারের আর্থিক অনুদানে মাদ্রাসা ও সংস্কৃতি কলেজ পরিচালিত হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আনুকূল্যে ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯২ সালে জোনাথন ডানকান প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি কলেজ । ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিক মেকলের ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান–বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারকে ভারত সরকারের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারি নীতির এ পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বাংলায় বেশ কিছু সরকার পরিচালিত, সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রধানত বাংলায় উচ্চাভিলাষী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনই সরকারি চাকরিতে ইংরেজি শিক্ষিতদের অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি প্রবর্তিত হয়’। প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দীন উমর ‘ভাষা আন্দোলন‘ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, শুধু সাংস্কৃতিক মহলই নয়, রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভাষাবিষয়ক কিছু উল্লেখযোগ্য চিন্তাভাবনা ছিল।
১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্য যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায় পাকিস্তান স্বাধীন হবার আগে থেকেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা প্রয়োগের দাবীতে সোচ্চার ছিল। বাঙালির প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে? এ দেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে , ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কাগজে কলমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধানে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কি ব্যবহৃত হচ্ছে? ইংরেজি যে জানে না, তার জীবনটাই যেন ব্যর্থ হওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। ইংরেজি যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সেহেতু ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকার অনেক গুরুত্ব রয়েছে বটে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত প্রয়োগ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগতভাবে বাংলা একাডেমির উপর বর্তায়। কিন্ত বাংলা একাডেমি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতি বছর কয়েক দফায় পদক বিতরণ করাই একাডেমির মুখ্য কাজ। এছাড়া তেমন কোনও কাজ আমাদের মত সাধারণ জনগণের চোখে পড়ে না। বাংলা ভাষার জন্য পাকিস্তান সরকারের বুলেটে রক্ত দিয়েছিল এই বাঙালিরা। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য যে গুটিকয়েক জাতি প্রাণ দিয়েছে তাদের মধ্যে বাঙালি অন্যতম। স্বাধীনতার জন্যও বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে এই পর্যন্ত এসেও এখনো রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাংলা ব্যবহারের জন্য আর্তনাদ ও বাংলা ভাষা ব্যবহারকে দেশের ভিতরেই নীচু বা হেয় চোখে দেখা আমাদের ভাষা শহীদদের আত্মদানের বিষয়টিকে খাটো করে দেখার নামান্তর। কিন্তু বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রের নেতৃত্ব থেকে আরম্ভ করে সর্বস্তরের জনগণকে আত্মসমালোচনা করার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, নিজ মাতৃভাষাকে প্রতিনিয়ত হেয় করে আমরা আসলে কি অর্জন করতে চাই? ইংরেজি ও প্রযুক্তির দাপটময় এই সময়ে বিশ্বের বুকে বাংলার মতো মধুর ভাষাটির প্রকৃত গন্তব্য আসলে কোথায়?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট