ভাষা শুধু ভাবের বাহন নয়, প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে নিজ জাতির প্রাণসত্তাটি বিকশিত করে তুলে। মানুষ মাতৃ–জঠর থেকে মুক্তি লাভ করে যে ভাষার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে, সেই মধুময় প্রাণপ্রিয় ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় শিক্ষা লাভ করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, ঠিক তেমনি মনের আশা–আকাঙ্ক্ষাও সঠিকভাবে প্রকাশে ব্যর্থ হয়। আর তাই হয়তো এ ভাবনায় ভাবিত হয়ে বাঙালি কবি প্রশ্ন করেছেন–‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা/পুরে কি আশা?’
এখানেই প্রশ্ন এসে যায়, আদিবাসীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সম্ভাবনা কতটুকু? ব্যক্তিগতভাবে আমি এ প্রশ্নের সমমুখীন হয়েছি বহুবার। কারণ আদিবাসীদের খবরাখবর রাখতে আমি চেষ্টা করি এবং সুযোগ পেলে, ডাক পেলে তাদের যে কোনো কাজে যুক্ত হতে গর্ববোধ করি। আমার ধারণা, এ ব্যাপারে যাঁরা কথা বলছেন এবং ভেবেছেন, তাঁরাও একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। এক্ষেত্রে সম্ভাবনা যাচাইয়ের আগে আদিবাসীদের অনীহার কারণ খুঁজতে চেয়েছি। তখনই আমাদের উপলব্ধিতে আসে, স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারণের কারণে বাংলাদেশে বসবাসকারী মাতৃভাষা বাংলা নয়, এমন সকল জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে সেই জাত্যাভিমানে সামপ্রদায়িক বিষবাষপ ছড়িয়ে তাকে আরও রক্তাক্ত করে তোলা হয়। ফলে এ দেশে কখনই অপরাপর জাতিসত্তাসমূহের ভাষা–সংস্কৃতি–কৃষ্টি শাসক শ্রেণির সহমর্মিতা লাভ করেনি। স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার মতো প্রয়োজনীয় জল–হাওয়া পায়নি। এরই প্রভাব পড়েছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সমপর্কে অনাগ্রহ এবং ধারণাগত সীমাবদ্ধতা। পাঠ্যপুস্তকসমূহেও আদিবাসীদের জীবনযাত্রা–কৃষ্টি–সংস্কৃতির কোনো প্রভাব প্রতিফলন নেই। এছাড়াও রয়েছে আর্থসামাজিক বৈষম্য এবং শিক্ষার পদ্ধতিগত সংকট। এছাড়া আছে ভাষা সমস্যা। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা যেমন বাঙালি শিক্ষকদের ভাষা বুঝতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের ভাষা এবং আচরণের সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। ফলে শিক্ষালয়ে পাঠদানের পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে। যা কি–না পাঠের সময়ে আদিবাসীদের বেদনাহত করে। এ সকল নানাবিধ কারণে অপরাপর বিষয়সমূহের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও আদিবাসী লোকসকল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে অছ্যুৎই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে সাফল্য লাভ করে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগের সঙ্গে বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আমার সমপৃক্ততার কথা উল্লেখ করতে গর্ববোধ করছি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ গ্রামীণ ট্রাসেট্রর দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণা কর্মসূচির অর্থায়নে সাঁওতাল শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি থানার বর্ষাপাড়া গ্রামে ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সাঁওতাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার এটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ। ফলে ধনুক ধরা আদিবাসী সাঁওতাল শিশুর হাতে বই ওঠে। পরবর্তীকালে এখানে আরও চারটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সাঁওতাল শিশুরা প্রথম যেই পুস্তকটি হাতে পায়, ঐটির নাম, ‘গিদরৌ কোয়া: পৗহিল পুথি’ অর্থাৎ প্রথম পাঠ। প্রথম বই হাতে পেয়ে সাঁওতাল শিক্ষার্থীরা আনন্দের আতিশয্যে সমস্বরে উচ্চারণ করে, ‘অ–তে অলঃ পড়হাঃ চেদ মা বোন, আ–তে আঃ সার মেনাঃ তি ঞ’ অর্থাৎ লেখাপড়া শিখবো মোরা, তীর ধনুক আছে আমার। এখানে মূলত সাঁওতাল বর্ণমালা শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মতোই সাঁওতাল ভাষায়ও স্বরবর্ণ এবং ব্যজ্ঞণবর্ণ আছে। তবে এখানে অতিরিক্ত দুটি স্বরবর্ণ ও ছয়টি ব্যঞ্জণবর্ণ আছে। আর আছে একটি অতিরিক্ত চিহ্ন। এটি হলো বাংলা (ৗ, ঔ চিহ্ন) চিহ্নের শেষ অংশ ৗ। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এটিকে বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি ভাষা বলছে। গ্রামীণ ট্রাসেট্রর অর্থায়নে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সাঁওতাল শিশুদের স্কুলগামীকরণের লক্ষ্যেই প্রথম বইটি রচনা করে। অতঃপর তাঁরা একটি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে একটি লেখক প্যানেল তৈরি করে। এ প্যানেলের একজন হিসেবে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেকে ঋদ্ধ করি। এ প্যানেলে সাঁওতাল ভাষা বিশেষজ্ঞও ছিলেন। আমাদের সমিমলিত উদ্যোগে প্রথমে সাঁওতাল ভাষায় রূপকথার বই ‘সেবেলে সড়ম বিসীবোন আজ্ঞুম’ লেখা হয়। পরে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ বিষয়ে একাধিক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত করি। ফলে সাঁওতাল শিশুরা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষার পরিবর্তে মূলভাষা হিসাবে সাঁওতালি ভাষা শেখে। অবশ্য তারা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে বাংলাকেও গ্রহণ করে। যাতে পরবর্তীকালে মূলধারায় শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। আদিবাসী জনসমাজে শিক্ষার বিস্তার এবং তাদের নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি সাঁওতাল ভাষায় প্রণীত বইসমূহে আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষা এবং তাদের এদেশের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো।
এ সকল সাঁওতাল স্কুল উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রের মতোই পরিচালিত হয়। একজন শিক্ষক ৩০জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দান করেন। শিক্ষালয়সমূহের সকল শিক্ষকই সাঁওতাল নারী। প্রথম শিক্ষালয়ের শিক্ষক হলেন বর্ষাপাড়া গ্রামেরই দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী পরীটুডু। দশম শ্রেণীর পর তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই সাঁওতাল স্কুল তাঁকে আবার উদ্যমী করে তুলে। পরীটুডু এখন স্বপ্ন দেখছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের, একই সঙ্গে সাক্ষর করে তুলবে নিজ জনগোষ্ঠীর সকল শিশুকে। একদিন যেখানে অভিযোগ ছিল, সাঁওতাল শিশুরা স্কুলে যায় না। সেখানে আমরা এসে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সাঁওতাল শিশুরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে না। অবশ্য এই স্কুল জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রতিষ্ঠিত স্কুল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা দীর্ঘদিন থেকে ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা’ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ইতোমধ্যে বেশ অগ্রগতিও হয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন করে সংস্থাসমূহ এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ সকল উদ্যোগ তুলে ধরার জন্য আমাদের স্মরণে আছে, গণসাক্ষরতা অভিযান ও সহযোগী সংস্থাসমূহ সম্মিলিতভাবে ‘মাল্টি–লিংগুয়াল এডুকেশন ফোরামও’(এমএলই ফোরাম) গঠন করেছিল। এই ফোরাম ২০১১ সালে ‘বাংলাদেশে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম’ শীর্ষক একটি ম্যাপিং স্টাডি পরিচালনা করে। ইউনেস্কো’র আর্থিক সহায়তায় এমএলই ফোরামের পক্ষে ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেক্টিভ’ এই ম্যাপিং স্টাডিটি পরিচালনা করে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক কী কী ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, কারা এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কী ধরনের শিক্ষাক্রম ও উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে ইত্যাদিসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত এই ম্যাপিং স্টাডিতে উঠে এসেছে। এছাড়াও সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে এমএলই কার্যক্রম সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজন ও সংগঠনের সুপারিশ স্টাডিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। এখান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৭৮টি আদিবাসী ও অ–আদিবাসী জাতিসত্তার জন্য ১০২টি সংস্থা ২৯টি জেলার ১১২টি উপজেলায় মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থাসমূহ হচ্ছে– ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, আশ্রয়, কারিতাস বাংলাদেশ, সান্তাল এডুকেশন সেন্টার। এছাড়া ব্র্যাক ও সিল–বাংলাদেশের অনেক সহযোগী সংস্থা ছোট ছোট আকারে দেশের বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমএলই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংশ্ল্লিষ্ট সংগঠনসমূহ আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাক–প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষাক্রম পরিচালনা করছে। স্টাডির প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় উন্নীত মোট ১৮৫ ধরনের উপকরণ ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য উপকরণসমূহ হচ্ছে বর্ণমালার চার্ট, গণণা চার্ট, প্রাইমার/বই, পোস্টার, ছবি, ক্লিপ চার্ট, কর্ণার সাজানোর উপকরণ, বিভিন্ন মডেল, ব্লক, ফ্লিপ চার্ট, পাজেল ইত্যাদি। সমতলের আদিবাসীদের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভাষায় উন্নীত বই ও উপকরণের সংখ্যা বেশি। শুধু চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় ৬১ ধরনের বইয়ের তথ্য পাওয়া যায়। স্টাডি থেকে জানা যায়, মোট ৫টি আদিবাসী ভাষায় নিজস্ব বর্ণমালা আছে। এগুলো হলো– চাকমা, চাক, মার্মা, ম্রো ও তঞ্চৈঙ্গা। ৮টি আদিবাসী ভাষায় বর্ণমালা হিসেবে রোমান এবং ৫৮টি আদিবাসী ভাষায় বর্ণমালা হিসেবে বাংলা–কে গ্রহণ করে উপকরণ উন্নয়ন করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে সরকার আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাক– প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসাবে প্রাক–প্রাথমিক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণীত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো ও ওঁরাও(সাদ্রি) ভাষাভাষী আদিবাসী শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা উন্নয়ন করা হয়। তবে সাঁওতাল বর্ণমালা বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্যের কারণে এ ভাষায় উপকরণ উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পর্যায়ক্রমে সকল আদিবাসীর জন্য নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এর অঙ্গীকার অনুসারে সকল আদিবাসীর জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক সতরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য সরকার ১১ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছিল। উপকরণ উন্নয়নের জন্য এনসিটিবি একটি উপকরণ উন্নয়ন কমিটি গঠন করে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, কলামিস্ট