প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কৃত্রিম নৌ চলাচল চ্যানেল গতকাল উদ্বোধন করেছেন। এই বন্দর দেশের অর্থনীতিতে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি চালু হলে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমবে। বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ভিত্তিপ্রস্তর হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে। খবর বাসসের।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এলাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যানেলটির উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রস্তাবিত টার্মিনাল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত প্রসারিত চ্যানেলটি মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে ২০২৬ সালে চালু করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানকার গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে বড় জাহাজ সরাসরি বিদেশি সমুদ্র বন্দরে যেতে পারবে এবং পণ্য লোড–অফলোড করা আরও সহজ ও সস্তা হবে এবং সময় সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ শুধু নয়, নেপাল, ভুটান এবং ভারতও এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এই ধরনের ব্যবহারে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দরকে আরও কার্যকর করতে পারি।
একই অনুষ্ঠানে গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরুর ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সমুদ্র সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কাজ করে যাচ্ছে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে সহযোগিতার জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তার সরকার মাতারবাড়িতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে এবং অন্যান্য উন্নয়ন কাঠামোর পাশাপাশি সেখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হবে। এলাকাটি জাতীয় বাণিজ্য ও ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করবে। তার সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর পরিচালনার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করবে।
এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল।
প্রসঙ্গত, ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেনার জেটি, ৩০০ মিটার দীর্ঘ বহুমুখী জেটি নির্মাণসহ ১৮.৫ মিটার ড্রাফট (জাহাজের পানির নিচের অংশ) এবং কন্টেনার ইয়ার্ডসহ বন্দরের বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে গতকাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। এই উন্নয়ন কাজ শেষ হলে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কন্টেনারবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিপিজিসিবিএল ইতোমধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ হিসাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দুটি জেটি নির্মাণ করেছে এবং এই চ্যানেলের মাধ্যমে ১২০টি জাহাজ চলাচল করতে পারবে। প্রায় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ারড পাওয়ার প্রজেক্টের অধীনে তৈরি হওয়ার পর গত ২০ সেপ্টেম্বর চ্যানেলটির দায়িত্ব সিপিএকে হস্তান্তর করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাতারবাড়ি বন্দর উদ্বোধনের পর বন্দরটি দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হবে। কারণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আর পণ্যের জন্য সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার বন্দরে অপেক্ষা করতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্য শিপমেন্ট পাঠাতে ৪৫ দিন সময় লাগে। বন্দরটি চালুর পরে গন্তব্যে পৌঁছাতে মাত্র ২৩ দিন লাগবে। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রস্থ এবং ১৬ মিটার গভীরতার ১৪.৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ১৫০ মিটার ব্রেক ওয়াটার (তরঙ্গ বাঁধা বাঁধ) নির্মাণ অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর দিকে এবং দক্ষিণ দিকে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বন্দর ও সড়ক নির্মাণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে জাপান সরকার মোট ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দেবে। বন্দরটি ২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ০.৬ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট কন্টেনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন টিইইউএস হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকবে।