দেশের বৃহত্তম লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ৭ উপজেলায় বন্ধ হয়েছে চলতি মৌসুমের লবণ উৎপাদন কার্যক্রম। এক নাগাড়ে বেশ কিছু দিন প্রচণ্ড তাপদাহের পর বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এর আগে লবণ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা অর্জিত হয়েছে বলে জানায় বিসিক। বর্তমানে লবণ মাঠ থেকে পলিথিন মুড়িয়ে নেওয়া ছাড়াও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদিত লবণ বড় বড় গুদামে, মাঠের গর্তে মজুদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সরেজমিন গত কয়েকদিন ধরে চকরিয়ার উপকূলীয় এলাকা ঘুরে লবণ উৎপাদন, বিকিকিনি ও মজুদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
মাঠ পর্যায়ের চাষিদের ভাষ্য, অতীতের বছরগুলোর চাইতে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনে নেমে শুরু থেকেই লোকসান গুণতে হচ্ছিল মাঠ পর্যায়ের চাষিদের। কারণ দেশে মধ্যসত্ত্বভোগী মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করায় মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক দরপতন ঘটে লবণের। এতে উৎপাদিত লবণ সড়কে ফেলে এবং কাফনের কাপড় গায়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করেন চাষিরা। তবে মৌসুমের শেষ মুহুর্তে এসে অন্তত উৎপাদন খরচ তুলতে পারায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা যায় চাষিদের।
চাষিরা বলছেন, দেশের ভোক্তা ও শিল্পখাতে চাহিদা মেঠানোর জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন চাষিরা। মৌসুমের শুরু থেকেই উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে খরচের টাকাও তুলতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় আর্থিকভাবে মার খেয়ে পরিবার–পরিজন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান লাখো চাষি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্য মতে, চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুম শুরু হয় ২০২৪ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। সেই থেকে চলতি বছরের মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়। মাঝখানে ১৭ এপ্রিল বৃষ্টিসহ ঝড়ো বাতাসের কারণে কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হয় লবণ উৎপাদন। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য মতে, গত ৬ মাসে দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ৭ উপজেলা তথা চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার আংশিক এলাকাসহ ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ চাষ শুরু করেন চাষিরা।
বিসিক আরও জানায়, দেশের ভোক্তা ও শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য লবণ উৎপাদনের জন্য সরকারিভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। মৌসুমের শেষ সময় পর্যন্ত এই চাহিদার লক্ষ্যমাত্রাও কাছাকাছি অর্জিত হয়। তবে উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তা তেমন প্রভাব পড়বে না জানিয়ে বিসিকের লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, মে মাসের শুরু থেকেই প্রচণ্ড তাপদাহ বহমান থাকায় দৈনিক ২৬ হাজার মেট্রিক টন করে লবণ উৎপাদন হয়েছে। এতে ঘাটতির পরিমাণ একেবারে কমে এসেছে। সর্বশেষ পর্যন্ত চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে।
বিসিক কর্মকর্তা আরও জানান, মৌসুমের শুরু থেকে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন নানা কারণে। তবে উৎপাদন মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে বাড়তে থাকে লবণের দাম। শুরুর দিকে প্রতি মণ লবণ ১৪০–১৫০ টাকায় বিক্রি হলেও পরবর্তীতের ২৮০–৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। যদিও মণপ্রতি লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হয়েছে ২৮০ টাকার মতো।
কক্সবাজারের বৃহৎ লবণ চাষি, লবণ চাষি সংগ্রাম পরিষদের জ্যেষ্ঠ নেতা ও চকরিয়া অ্যাডভোকেট এসোসিয়েশনের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রচণ্ড তাপদাহে যখন প্রাণীকূল অতিষ্ট, তখন বৃষ্টিপাতের জন্য হাহাকার করছিলেন প্রাণীকূল। একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন এই প্রচণ্ড তাপদাহ আশীর্বাদ হিসেবে বর্ষিত ছিল লবণ চাষিদের জন্য। এই সময়ে দেদার লবণ উৎপাদন হয়। তাই সরকার কর্তৃক নিরূপণকৃত লবণের চাহিদার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে এবারও।
চাষিরা জানিয়েছেন, উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না হওয়ায় মাঠে উৎপাদিত লবণ বড় বড় গুদামে এবং মাঠেই বিশালায়তনের গর্ত করে সেখানে মজুদ করে রেখেছেন। পুরো কক্সবাজার অঞ্চলে কম করে হলেও অন্তত ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদিত দেশীয় লবণ মজুদ করে রাখা হয়েছে। যখনই লবণের দাম একটু বাড়তির দিকে যাবে, তখন মজুদকৃত এসব লবণ বিক্রি করা হবে।