মাঠের অভাবে জব্বারের বলী খেলা না হলেও মেলার আয়োজনে বাধা কোথায়

| শনিবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা বন্ধের খবরে নগরবাসীর মন খারাপ। যে মাঠে এই বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয় সে লালদীঘি মাঠ এখনো উন্মুক্ত নয়। সে কারণে জব্বারের বলী খেলার এবারের আসর স্থগিত ঘোষণা করেছে আয়োজক কমিটি।
গত ১৪ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, যেহেতু লালদীঘির মাঠ এখন সংস্কার কাজের মধ্যে রয়েছে সেহেতু এই মুহূর্তে সে মাঠে বলী খেলা আয়োজন করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করা হয়েছিল এই লালদীঘি মাঠ থেকে। তাই এই মাঠের চার পাশে সে ছয় দফার ম্যুরাল স্থাপন করা হচ্ছে। আর মাঠটিকে সাজানো হচ্ছে নতুনভাবে। আয়োজকরা জানান, আমরা চিন্তা করেছিলাম যদি মাঠটি তৈরি হয়ে যায় তাহলে এবারে ১২ বৈশাখ জব্বারের বলী খেলা আয়াজন করা হবে। কিন্তু মাঠের অনুমতি মেলেনি। যেহেতু মাঠের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তাছাড়া যেহেতু জব্বারের বলী খেলার নির্ধারিত তারিখ ১২ বৈশাখ সেহেতু অন্য কোন তারিখেও এটা আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এবারের জব্বারের বলী খেলা আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না মাঠ সংকটের কারণে।
খবরটি গণমাধ্যমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। বেশিরভাগ মানুষ খেলা ও মেলা বন্ধের পক্ষে নন। মেলা বন্ধের সমস্ত দোষ সরকারের কাঁধে এসে পড়ছে। অনেকে এর পেছনে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাত আছে বলে অভিযোগ করছেন। তাঁরা বলছেন, ‘যদি সামপ্রদায়িক-মৌলবাদী অপশক্তির ভয়ে ভীত হয়ে আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান বন্ধ ও সংকুচিত করা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর। তা নিশ্চিত না করে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরা কোনভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।’
জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা ঐতিহ্যের অংশ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে বদরপাতি এলাকার তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চৌধুরী লালদীঘির মাঠে প্রচলন করেছিলেন জব্বারের বলী খেলার। কালের বিবর্তনে সে বলী খেলা এখন আর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ঐতিহ্যে। ১৯০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে জব্বারের বলী খেলার ১১০টি আসর। এরপর করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ এবং ২০২১ এই দুটি আসর আয়োজিত হতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খেলা ও মেলা না হওয়া খুবই দুঃখজনক। বলা বাহুল্য, বলী খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ মেলা সুদীর্ঘকাল থেকে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। এ মেলা থেকে সারা বছরের গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্র সংগ্রহ করেন গৃহকর্ত্রীরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দোকানিরা শামিয়ানা টাঙিয়ে এবং কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন মেলায়।
বলী খেলাকে বাঙালির প্রাণের উৎসব উল্লেখ করে যে কোন মূল্যে একে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। পত্রিকায় প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, গ্রামীণ শিল্পীদের তৈরি করা নকশীকাঁথা, মাছ ধরার চাঁই, বেতের তৈরি চালুনি, ঝাড়ু, কুলা, হাতপাখা, হাঁড়ি-পাতিল, কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র, শীতলপাটি, কারুকাজ করা পিঠার ছাঁচ, রুটি বেলার বেলুনি ও পিড়া, পোড়ামাটিতে তৈরি বিভিন্ন মৃৎপাত্র, মটকা, মাটির কলস, ফুলদানিসহ নানা রকমের নিত্যব্যবহার্য পণ্য বিক্রি হয় এই মেলায়। তাছাড়া কৃষি সমাজের সারা বছরের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি কাস্তে, কোদাল, শাবল, শস্যবীজসহ নানা প্রকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কৃষকেরা সংগ্রহ করতো এ মেলা থেকে। মোটামুটিভাবে সারা বছরের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র মেলা থেকে সংগ্রহ করে বাসা বাড়িতে নিয়ে আসেন নারী, পুরুষসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। আর এ মেলাকে কেন্দ্র করে বছরব্যাপী এসব জিনিসপত্র তৈরীতে ব্যস্ত থাকে বিক্রেতারা। তাই যে কোন মূল্যে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
নানা অজুহাত, নানা কৌশলে বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। তাঁরা বলেন, মাঠের কারণে যদি খেলার আয়োজন করা না যায়, মেলা হতে আপত্তি কোথায়? মেলা তো রাস্তায় হয়। পুলিশ রাস্তায় মেলা করতে না দিলে শত বছরের ঐতিহ্য নস্যাৎ হবে বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। এ বছরসহ তিন বছর এই বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা হচ্ছে না, এভাবে আর কয়েকবছর যদি নানা কৌশলে বন্ধ রাখা যায়, তাহলে এটি হয়তো চিরতরেই বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের উচিত, এ খেলার আয়োজন করতে না পারলেও মেলার আয়োজন অব্যাহত রেখে ঐতিহ্য ধরে রাখা। মনে রাখা দরকার, এর সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতির মৌল দর্শন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং সরকারের ভাবমূর্তি জড়িত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে