চট্টগ্রামে মেট্রোরেল চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাটির উপর এবং নিচ উভয় দিকে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। যেটা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান এবং পরিবেশবান্ধব হবে সেভাবেই মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৭১ কোটি টাকা। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্প ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন।
গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, চট্টগ্রামে মেট্রোরেল হবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের আমদানি–রপ্তানির বেশিরভাগ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রাম গ্রিন সিটি ও বন্দর নগরী। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।
মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন ঘোষণা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আজকের দিনটি চট্টগ্রামের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন, গুরুত্বপূর্ণ দিন। চট্টগ্রামের তরুণ প্রজন্মের ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ এমআরটি। আজ মেট্রোরেল বা এমআরটির মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজের সূচনা হচ্ছে। আজকের দিনটি চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বহু প্রতীক্ষিত দিন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার উদ্যোগ ৭ম পৃষ্ঠার ৬ষ্ঠ কলাম
নিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই কাজ হবে।
কাদের বলেন, চট্টগ্রাম–কঙবাজারের মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে বিদ্যমান সড়কটি জাইকার সহায়তায় চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটনশিল্প বিকাশের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে কঙবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ রোড নির্মাণে যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ অচিরেই শুরু হবে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভৌত কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ইলেকট্রো–মেকানিক্যাল কাজ চলছে। এছাড়া নিরাপত্তামূলক দিক বিবেচনা করে স্ক্যানার স্থাপন করা হবে। আনুষঙ্গিক কিছু কাজ রয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টানেলের উদ্বোধন করবেন বলে জানান তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে হোটেল রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ঢাকার আগারগাঁও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। ঢাকায় একটি মাল্টি লাইন পাতালরেল ২১ কিলোমিটার নির্মিত হচ্ছে। এই পাতালরেলে ব্যয় হবে ৫২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপানের জাইকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। ঢাকা সিটিতে আরো ছয়টি মেট্রোরেল ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, সামান্য উত্তরা থেকে আগারগাঁও মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর যে ঠাসাঠাসি, বৃদ্ধ–বৃদ্ধা, তরুণ–তরুণীসহ সব বয়সী মানুষ মেট্রোরেলে চড়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে; সেই মেট্রোরেলের আকর্ষণ চট্টগ্রামেও নিশ্চয়ই হবে।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ রওশন আরা মান্নান, বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ঝাং কিউন, ইআরডি সচিব শরিফা খান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ, ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন, ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিচালনাকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোইকা বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইয়াং–আহ দোহ ও চট্টগ্রামের মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপক টনি ইলহো জং।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আজকে চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি শুভদিন, আনন্দের দিন। কারণ চট্টগ্রামে মেট্রোরেল হবে চট্টগ্রামের মানুষও অনেকে ভাবেননি। এটি আমার জন্যও আনন্দের দিন। বেশ কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে বহুবার নিবেদন করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আজকে কোরিয়ান সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে বিশ্বমন্দা চলছে। সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতির মধ্যে অনেক প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে সরকার। বিশ্বময় অনেক প্রকল্পের কার্যক্রম ধীরগতি হয়ে গেছে। সেই পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী এই চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামকে নান্দনিক শহর উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নকে যে কি পরিমাণ গুরুত্ব দেন, সেটি একটি প্রজেক্টের কথা আলোচনা করলেই বুঝতে পারবেন। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য তিনটা প্রজেক্ট মিলিয়ে ব্যয় ১.২ মিলিয়ন ডলার তিনি দিয়েছেন। সেই কাজগুলো চলছে। তিনটা প্রজেক্টের কাজের সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সেই প্রজেক্টগুলো যদি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়, আমি আশা করি আগামী বছর থেকে চট্টগ্রাম শহরে পানি উঠবে না।
তিনি বলেন, অনেকগুলো পাহাড় কাটা হয়েছে। পাহাড় কাটার কারণে নান্দনিকতা নষ্ট হয়েছে, পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরকে আরো নান্দনিক করার ক্ষেত্রে মেট্রোরেল প্রজেক্টটি অত্যন্ত সহায়ক হবে। এই শহরের লোকসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগামী পাঁচ–দশ বছর পরে এই শহরের লোকসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই শহর ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সুতরাং এখানে মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমি মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পরপরই চট্টগ্রাম শহরে মেট্রোরেল করার প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলাম। তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদও বলেছেন, মেট্রোরেল হলে চট্টগ্রাম আরও নান্দনিক শহরে পরিণত হবে। চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই।
চট্টগ্রামের মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপক টনি ইলহো জং বলেন, আমরা চট্টগ্রামে মেট্রোরেল, পাতালরেল করার লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করব। উড়ন্ত মেট্রোরেল হবে কিনা, তা–ও যাচাই করা হবে। তবে প্রধান লক্ষ্য পাতালরেলের সম্ভাব্যতা যাচাই। এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা এমনভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাই, যাতে সাকসেস হই। মেট্রোরেল হলে চট্টগ্রামের চেহারাও পাল্টে যাবে। পরিবহনের ওপর চাপ কমবে। মানুষের সময় বাঁচবে। এতে চট্টগ্রামের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করবে।
উল্লেখ্য, কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোইকা চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে। ৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত ফিজিবিলিটি স্টাডিতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা, ব্যবহার উপযোগিতা, মেট্রোরেলের রুটসহ নানা বিষয় উঠে আসবে। এই সমীক্ষাতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা–ও উঠে আসবে বলে সূত্রে জানা গেছে।