মাজার অর্থ জেয়ারতের স্থান, সোহবতের স্থান। যেখানে আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ বিশ্রামে শায়িত। যেখানে জেয়ারত করে আত্মার শান্তিসহ আল্লাহর নেয়ামত উপলব্ধি করা যায়। খানকাহ্ হল সুফি, দরবেশদের বিশ্রামাগার ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র; যেখান থেকে সুফিরা ধর্মীয় ও বুদ্ধিভিত্তিক জীবনচর্চার শিক্ষা দেন। যে শিক্ষায় আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আসে।
সাধারণ বান্দাদের কবর জেয়ারত এবং আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের মাজারে জেয়ারতে আসমান জমিন তফাৎ রয়েছে। কবর জেয়ারতে কবরবাসীর আত্মার মুক্তির জন্য দোয়া করা হয়। অপরদিকে মাজার জেয়ারতে অলির সোহবত ও উসিলায় নিজের জাগতিক, আত্মিক মুক্তির জন্য দয়া চাওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে আছে,-‘আমরা আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত হলাম। আল্লাহর চেয়ে অধিক রঙ্গিন (গুণসম্পন্ন) আর কে হতে পারে? এবং আমরা তাঁরই ইবাদত করি (সূরা বাকারা,১৩৮)’। রসূল(দ.)’র আদর্শ ধারণ, প্রবৃত্তিকে বিনাশ, স্মরণ, সন্তুষ্টসহ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়েছেন, তাঁরাই আউলিয়া। হাদিসে কুদসিতে আছে, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে কতক প্রেমিকবান্দা রয়েছেন যাঁরা এবাদতের মাধ্যমে আমাকে এতই সন্তুষ্ট করেছেন যে– তাঁরা যখন কথা বলে সেটি আমার কথা, যে কান দিয়ে শুনে সেটি আমার কান, যে চোখ দিয়ে দেখে সেটি আমার চোখ, তাঁরা আমাতে পরিণত হয়’। এঁরা আধ্যাত্মিক অথরিটিপ্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত থাকেন এবং জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আলোর পথ দেখায়। তাঁদের সাথে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে। আল্লাহ তাঁদেরকে অতিব সম্মানিত করেছেন। তাঁদের শেষ বিশ্রামস্থানকে কারুকার্যখচিত গিলাপ, গম্বুজ সহকারে মাজার (সৌধ)করে তাদের মর্যাদা দেয়া হয়। স্বয়ং রসূল (দ.)’রও মাজার শরিফ রয়েছে। রসূল(দ.)কে নিজ ঘরে দাফন করে মর্যাদার সাথে সবুজ গম্বুজসহ সৌধ নির্মাণ করা হয়। হযরত আবু বকর(র.), হযরত ওমর (র.)’র ওফাতপরবর্তী তাদেরও সৌধের মধ্যে দাফন করা হয়। ধীরে ধীরে এটি ইসলামের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এর ধারাবাহিকতায় রসূলেপাক (দ.)’র পদাঙ্ক অনুসরণকারী আউলিয়াগণেরও স্মৃতিরক্ষা, সম্মান ও দয়াপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মাজার করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়–আরবে রসূল(দ.)’র সম্মানিত– পিতামাতা, চাচা, কন্যাগণ, বিবিগণ, এমনকী দাসীসহ পবিত্র সত্তাসমূহের মাজার ছিল। ওমরা–হজ্জপালনকারীরা সেখানে জেয়ারত করতেন। মৌলভী এয়ার মোহাম্মদ (চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক ওবায়দুল হকের দাদা) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই হয়ে দীর্ঘ চার মাস ভ্রমণ করে পবিত্র হজব্রত সম্পন্ন করেন।দেশে ফিরে ‘ছফরনামা (আরব ও হেজাজ) নামক একটি ভ্রমণকাহিনীমূলক গ্রন্থ লিখেন। তিনি জেয়ারত করেছেন এরকম শতাধিক মাজারের কথা এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এগুলোর কোনটাতে গম্বুজ, রেলিং দেওয়া, কোনটাতে গিলাপ চড়ানো, তাও উল্লেখ করেছেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের পর অভিশপ্ত এজিদের অনুসারী আব্দুল ওহাব নজদীগণ আহলে বায়েতের বংশ ও আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে মাজারসমূহ গুড়িয়ে দিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ বিভিন্নদেশেও অলি আউলিয়ার অগণিত মাজার রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কতকগোষ্ঠী ফেৎনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মাজার ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। বেশকয়েকটি মাজার ভাঙাও হয়েছে। তারা মাজার ধ্বংসলীলায় মেতেছে। যাঁরা আল্লাহ, রসূলকে চিনিয়েছেন, তওহীদের বাণী শুনিয়েছেন, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত, আল্লাহ প্রেমে উদ্বোদ্ধসহ, শান্তির বাণী প্রচার করেছেন; কতকগোষ্ঠী ইসলামের দোহাই দিয়ে উম্মাদের মত তাঁদেরই মাজারে আঘাত করছে। তারা কেন, কী উদ্দেশ্যে করছে, তারাই ভালো জানে। কোনো সভ্যজাতি গর্হিত, নিন্দনীয় কাজকে সমর্থন করতে পারে না। তথাকথিত কিছু বানোয়াট মাজার থাকতে পারে। এসব বানোয়াট মাজার কিংবা কিছু প্রকৃত মাজারকে কেন্দ্র করেও কিছুব্যক্তি কিছু নেতিবাচক কর্ম করতে পারে। তাই বলে সকল মাজার ধ্বংসের আওয়াজ তুলতে হবে, এটা কোনধরনের বর্বরতা? কোনোব্যক্তি অপরাধ করলে তার জন্য প্রশাসন, আইন, আদালত রয়েছে। তাদেরকে প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত করা যায়। কিন্তু কোনোব্যক্তির ভুলত্রুটি, অপরাধের কারণে উগ্রভাবে ক্রোধান্বিত হয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানের (মাজার) উপর আঘাত অভিশপ্ত এজিদিয় চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। দেশে অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছুপ্রতিষ্ঠানে শিশু বলৎকারের মত জঘন্য অপরাধও ঘটে, যেগুলো সকলের জানা। অনেক প্রতিষ্ঠানের কিছুব্যক্তি দুর্নীতির সাথে জড়িত। কিন্তু ব্যক্তিঅপরাধের দায়ে প্রতিষ্ঠানে আঘাত করতে দেখি না। করা উচিতও নয়। মাজারককেন্দ্রিক কিছু অপরাধী থাকতে পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তি অপরাধের দায়ে যখন পুরো মাজার কিংবা মাজার কমপ্লেঙের উপর আক্রমণ হয় তখন বোঝার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না যে তারা এজিদিয় ভাবধারা, চেতনাকে লালন করছে। সুফিকবি হযরত জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহকে পাওয়ার অনেক রাস্তা রয়েছে, আমি প্রেমকে বেছে নিয়েছি। যে যার মত আল্লাহকে ডাকবে; এটাই স্বাভাবিক। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য, শিক্ষা। কেউ কারো মত ও পথে বাঁধা নয়। জোরপূর্বক নিজের মতকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া কোনো ধর্মই সমর্থনযোগ্য নয়। সুফিবাদি মত গ্রহণ করেন কিংবা না করেন, মাজারে বিশ্বাস করেন কিংবা না করেন কিছু এসে যায় না। তাই বলে মাজার বিশ্বাসীদের উপর আক্রমণ সম্পূর্ণই এজিদিয় চরিত্রের বহিপ্রকাশ। মূলত তারা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে ইসলামধর্মকে কলঙ্কিতসহ দেশে অশান্তি ডেকে আনছে। অথচ আল্লাহ বলেছেন,‘তোমরা ফ্যাসাদ করিও না, ফ্যাসাদ হত্যা থেকেও নিকৃষ্ট’। এজিদিয় ভাবধারায় লালিত হয়ে মাজার নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালালেও রসূলপ্রেমিকদের হৃদয় থেকে আহলেবায়েতের মহব্বতকে কখনো দূর করা সম্ভব নয়। আউলিয়া সত্য, তাঁদের দর্শন সত্য। সত্যকে ক্ষণিক ধামাচাপা দেওয়া যায় কিন্তু চিরতরে ধ্বংস করা যায় না।
সুফিরা অসমপ্রদায়িক চেতনাধারণকারী ও উদার। উদারতা দিয়ে সকল ধর্মানুসারির হৃদয় জয় করেছেন। সর্বধর্ম সমন্বয় জীবেপ্রেম, সমপ্রীতির বন্ধন রয়েছে তাঁদের চেতনায়। ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, কোনো ভেদাভেদ করে না। তাই সকল ধর্মানুসারীরা পার্থিব, অপার্থিব অনুগ্রহের জন্য নিয়মিত তাঁদের খানকায় যাওয়া আসা করে। ফলে এসব খানকাহ হয়ে ওঠে সকল জাতির মিলনকেন্দ্র। উদার ভালোবাসা, মেহমানদারীসহ উত্তম আচরণের জন্য সকলের শ্রদ্ধাভাজন হন।
সুফি, আউলিয়াদের সন্তুষ্ট করার অর্থই হলো পরোক্ষভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। ভক্তরা এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে হৃদয়ে ধারণ করে। আউলিয়ার দরবারে উপহার নেওয়া রসুলুল্লাহর সুন্নত। সাহাবীরাও নিয়মিত রসূলুল্লাহর দরবারে বিভিন্ন হাদিয়া নিতেন। এশিক্ষা নিয়ে আউলিয়াদের দরবারেও ভক্তগণ হাদিয়া নজরানা নিয়ে শরিক হন। এই অর্থ দিয়ে খানকাহকে কেন্দ্র করে সেবামূলক কমপ্লেঙ গড়ে ওঠে। খানকাহ‘র সুফি ওফাতের পর মাজার নির্মাণ করা হয়। মাজারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কমিটি, আঞ্জুমান, ট্রাস্টের মাধ্যমে সেবামূলক কাজ আরো বৃদ্ধি পায়। ধীরেধীরে মসজিদ, মাদ্রাসা ফ্রি চিকিৎসাকেন্দ্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হেফজখানা, মুসাফিরখানা, শিক্ষাবৃত্তি, বন্যার্তদের সাহায্য, গৃহহীনদের গৃহনির্মাণসহ বিভিন্নভাবে সহায়তাসহ মানবতার কল্যাণ করা হয়। এরকম কয়েকটি দরবারভিত্তিক সংস্থা হল–চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরিফের গাউছিয়া হক মঞ্জিলকেন্দ্রিক সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্ট, আহমদীয়া মঞ্জিলকেন্দ্রিক সৈয়দ এমদাদুল হক(ম.)মাইজভান্ডারী ট্রাস্ট, দারুল ইরফান ইনস্টিটিউট, আঞ্জুমানে সৈয়দ মুনিরুল হক (রহ.) মাইজভাণ্ডারী, আঞ্জুমানে ডা.সৈয়দ দিদারুল হক (ম.)মাইজভাণ্ডারী, আঞ্জুমানে সৈয়দ শহিদুল হক (ম.)মাইজভাণ্ডারী, রহমানিয়া মঞ্জিল সৈয়দ মুজিবুল বশর (ম.) মাইজভাণ্ডারী, সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ (ম.)মাইজভাণ্ডারীর মইনিয়া ট্রাস্ট, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফকেন্দ্রিক হযরত শাহসুফি মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ‘র ফয়েজিয়া মঞ্জিলের রহমানিয়া ফয়েজিয়া ফাউন্ডেশন, রাহাতিয়া নঙবন্দিয়া দরবার, ফরহাদাবাদ দরবার, আমিরভাণ্ডার,আলীরজা কানুশাহ দরবার, আকবরিয়া দরবার, হজরত শাহআমানত দরগাহ, ভারতের আজমীরশরিফ,নিজামুদ্দিন আউলিয়া দরগাহ,পাকিস্তানের হযরত দাতাগঞ্জবঙের দরবার, ছিরিকোট দরবারসহ বিশ্বের অসংখ্য দরবারের আঞ্জুমান, কমিটি, ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রচারবিহীন আর্তমানবতার কল্যাণ হচ্ছে। বিশেষকরে বলতে হয়–চট্টগ্রামের গাউসিয়া হক মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীন, মানবতার ফেরিওয়ালা রাহবারে আলম সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান(ম.) মাইজভাণ্ডারী কর্তৃক পরিচালিত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের মাধ্যমে শিক্ষা, চিকিৎসা, বনায়ন, বন্যার্ত, হতদরিদ্র, গবেষণাসহ বিভিন্নখাতে নজিরবিহীনভাবে দরবারের এবং ব্যক্তিগত ফাণ্ডের অর্থ দিয়ে মানবতার খেদমত করে যাচ্ছেন, যা সকলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দেশবিদেশে অসংখ্য শাখাপ্রশাখার (খানকাহ্) মাধ্যমেও সহায়তা করা হয়। শুধু কি তাই! দরবারের নৈতিকশিক্ষা ধারণ করে আশেক ভক্তগণও ব্যক্তিগতভাবে মানবিক কাজে শারীরিক ও আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছেন।
মাজার/খানকাহকে কেন্দ্র করে একদিকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তৈরী হয়। অপরদিকে হাদিয়া, নজরানার অর্থ দিয়ে মানবকল্যাণসহ দেশগঠনে ভূমিকা রাখে। যারা মাজার/খানকাহ্ ধ্বংস করছে তারা মূলত বিবেকসম্পন্ন মানুষ তৈরীসহ মানবকল্যাণের কারখানাকে ধ্বংস করছে। কারণ–এখানে মানবিক মানুষ তৈরী, যাদের দ্বারা দেশ ও দশের কল্যাণ হয়। মাজার/খানকাহ‘র সংস্কৃতি অতীতে আরবেও ছিল, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ সহ সারাবিশ্বে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাজ্জদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।