সাধারণভাবে কালো টাকা হিসেবে অপ্রদর্শিত আয় সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেওয়াকে বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ শিকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশের পরদিন গতকাল শুক্রবার বিকালে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাবের স্মরণে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। দিনটিকে ছয় দফা দিবস হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগ। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই টাকার উৎস কী, সেই প্রশ্নও করা হবে না। খবর বিডিনিউজের।
সংসদের বাইরে বিরোধী দল বিএনপি, অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান টিআইবি এমন বিধানের সমালোচনা করছে। তারা বলছে, এমন বিধান নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না। বিএনপির পক্ষ থেকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার বলেছেন, এই যে লুটপাটের কালো টাকা বাজেটে ১৫% (কর) দিয়ে হোয়াইট করা হয়, তাহলে তো যারা আমরা খেটে খাওয়া লোক আছি, তাদের সঙ্গে ওদের (কালো টাকার মালিক) তো পার্থক্য থাকছে না। ট্যাক্স দিয়ে যদি হোয়াইট করা যায় তাহলে তো ইউ উইল বি এনকারেজিং ডিজঅনেস্টি।
নানা মহল থেকে আসা বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা প্রশ্ন আসছে কালো টাকা নিয়ে। কালো টাকা নিয়ে আমি শুনি, অনেকে বলে কালো টাকা? ‘তাহলে আর কেউ ট্যাঙ দেবে না’। ঘটনা কিন্তু এটা না, এটা শুধু কালো টাকা না। জিনিসের দাম বেড়েছে। এখন এক কাঠা জমি যার, সেই কোটিপতি। কিন্তু সরকারি যে হিসেব, সেই হিসেবে কেউ বেচে না, বেশি দামে বেচে বা কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হয়। এই টাকাটা তারা গুঁজে রাখে। গুঁজে যাতে না রাখে, সামান্য একটা কিছু দিয়ে যাতে সেই টাকাটা আসল পথে আসুক, জায়গা মতো আসুক। তার পরে তো ট্যাঙ দিতেই হবে।
বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, আমি বলি মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না। সেই রকম একটা ব্যবস্থা, এটা আসলে আগেও হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু করেছিল, আর পরেও প্রত্যেক সরকারই করে। সেই সুযোগটা আমরাও দিয়েছি। অল্প ট্যাঙ দিয়ে সেই টাকাটা তোমরা ব্যাংকে নিয়ে আস, সেই ব্যবস্থাটাই হয়েছে। এটা নিয়ে নানা জনে নানা কথা। কিন্তু তারপরেও যেগুলো মানুষের প্রয়োজন সেই ক্ষেত্রে ট্যাঙ কমিয়ে দিয়েছি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ : প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করে সরকারপ্রধান বলেন, বিশেষ করে খাদ্যমূল্য, সেখানে উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। বৃষ্টির কারণে যেমন আলুর বীজ নষ্ট হয়ে গেছে, তো এই রকম অনেক কিছু আছে। আমরা এখনও উৎপাদনমুখী হলে খাদ্যে কোনোদিন অভাব হবে না।
বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে পরিকল্পনা নিয়ে চলতে হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে যা হচ্ছে… কিছু ভালো লাগে না। তাদের ভালো না লাগাই থাক, কান দেওয়ার দরকার নাই। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে প্রান্তিক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, নিম্নআয়ের মানুষ যারা, এই সীমিত আয়ের মানুষ যারা, তাদের জন্য আমরা পারিবারিক কার্ড করে দিয়েছি। যারা একেবারে হতদরিদ্র তাদের তো একেবারে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি। আর সামাজিক নিরাপত্তা তো বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি।
প্রত্যেকটা জিনিস আমরা উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বেড়েছে, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। এখন আর দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হয় না। কমপক্ষে দুই বেলা খাবার তো পাচ্ছে মানুষ। সেখানে গ্রহণটাও বেড়েছে চাহিদাটাও বেড়েছে, আমরা সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়িয়েছি।
মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধকেও দায়ী করে তিনি বলেন, আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কোভিড–১৯ এর অতিমারী দেখা দিল। এই অতিমারীর ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে, আমরাও সেই মন্দায় পড়ে গেলাম। সারা বিশ্বে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেল। এরপর আসল ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ, এরপর স্যাংশন–পাল্টা স্যাংশন। স্যাংশনের ফলে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
রিজার্ভের চেয়ে বেশি দরকার মানুষের চাহিদা পূরণ : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসার কারণে যে চাপ ও সমালোচনা, সেটি নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের মানুষকে খাওয়াতে হবে আগে। আমাদের রিজার্ভ কত আছে না আছে সেটার চেয়ে বেশি দরকার আমার দেশের মানুষের চাহিদাটা পূরণ করা। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পানির মতো টাকা খরচ করেছি। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেটা কোনো উন্নত দেশ করে নাই, বিনা পয়সায় কোভিড–১৯ এর ভ্যাকসিন দিয়েছি, বিনা পয়সায় টেস্ট করিয়েছি। সেটা করেছি কেন? মানুষ বাঁচাতে। চিকিৎসা বিনা পয়সায়, যে ডাক্তার চিকিৎসা করেছে, তাদের প্রতিদিন আলাদা ভাতা দিতে হতো। তারা যে চিকিৎসা দিচ্ছে এভাবে পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে। তারপর যখন দাম বেড়েছে, তখন দুইশ ডলারের গম ছয়শ ডলার করেও আমি কিনে নিয়ে এসেছি। ঠিক সেইভাবে তেল ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তার পরেও আমরা যে এবার বাজেট দিতে পারলাম।
মানুষের চাহিদা পূরণের ভাবনা থেকেই এই বাজেট দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে বসে বসে হিসাব কষে, আগে এত পার্সেন্ট বেড়েছে, এবার কম পার্সেন্ট বাড়ল কেন? এখন সীমিতভাবে খুব সংরক্ষিতভাবেই আমরা এগোতে চাই। যেটা আমাদের দেশের মানুষের কষ্ট না হয়, মানুষের যে চাহিদাটা সেটা যেন পূরণ করতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বাজেট করেছি।
এবারের বাজেটে মৌলিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির আমলে সবশেষ বাজেট মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকার। সেখানে আমরা ৭ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছি। এই বাজেটে এবার কতগুলো মৌলিক চাহিদা… মানুষের মৌলিক যে অধিকার, সেটাকে নিশ্চিত করার জন্য, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য তারপর দেশীয় শিল্প, সেগুলো এবং সামাজিক নিরাপত্তা, এইগুলোকে সব থেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।