৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ২৪ দিন পার হতে চললেও এখনো সাগরে মাছ ধরায় সুবিধা করতে পারছেন না জেলেরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞার পর বৈরী আবহাওয়া ও দফায় দফায় আবহাওয়ার সতর্কতা সংকেত বজায় থাকায় মাছ ধরা যাচ্ছে না। আবহাওয়ার বৈরী পরিস্থিতির কারণে সাগরে টিকতে না পারা ও দুর্ঘটনার ভয়ে শত শত মাছ ধরার বোট নোঙর করে আছে কূলে। এতে জেলে ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। আর মাছশূন্য পড়ে আছে জেলার প্রধান মৎস্য আড়ত কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রসহ সবগুলো আড়ত। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও প্রায় শূন্যের কোটায়।
জেলেরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। এতে সৃষ্ট বড় বড় ঢেউয়ের কবলে বোট অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না।
কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ১২ জুন ৫৮ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার মুহূর্তে সাগর উত্তাল হয়ে পড়েছে। গত ১৮ দিনে সাগরে তিনটি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখনো সাগরে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া অনিরাপদ। ফলে কক্সবাজার সদরসহ মহেশখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়ার ছোট–বড় অন্তত ৬ হাজার ট্রলার ঘাটে পড়ে আছে। কিছু ট্রলার ঝুঁকি নিয়ে সাগরের কাছাকাছি এলাকায় গিয়ে জাল ফেলে ছোট আকৃতির লইট্যা, ফাইস্যা, পোঁপা, ছুরি ধরে আনলেও ইলিশের দেখা নেই। ইলিশসহ বড় বড় মাছ ধরতে গেলে ৭০–৮০ কিলোমিটার দূরে গভীর সাগরে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়া যাচ্ছে না। ২০ জুলাই পর্যন্ত সাগরের উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে কক্সবাজার ফিশারিঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য বোট কূলে নোঙর করে রয়েছে। অল্প কিছু বোট মাছ ধরে কূলে ফিরছে। এসব বোটে ইলিশ বা বড় আকারের মাছ খুব একটা দেখা মিলছে না। চিংড়ি, লইট্টা, ছুরি, শাপলা, কালো চাঁদা ও রূপচাঁদা মাছ ধরা পড়লেও তা পরিমাণের তুলনায় অনেক কম।
এফভি ফাহিম নামে বোটের মাঝি আবদু শুক্কুর বলেন, একদিকে মাছের সংকট, অন্যদিকে সাগর উত্তাল থাকায় অবস্থান করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেসব বোট মাছ ধরতে যাচ্ছে তারা অনেকটা খালি হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। বড় ঢেউ আর বাতাসের কারণে সাগরে দীর্ঘ সময় থাকা যাচ্ছে না। তাই অনেক বোট ফিরে আসছে খালি হাতে।
এফবি দেলোয়ার নামে আরেক বোটে অবস্থান করা জেলে ফজল উদ্দিন বলেন, সাগরে যেতে না পেরে কূলে নোঙর করে বসে আছি ৯ দিন। অন্যরা বাড়ি চলে গেছে, আমি বোট পাহারায় আছি।
এভাবে শত শত বোট কূলে নোঙর করে বসে আছে। এসব বোটে পাহারাদার ছাড়া অন্যরা বাড়ি চলে গেছে। এদিকে মাছ ধরা না পড়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার প্রধান কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে পুরো পল্টন মাছে ভরে যায়, সেখানে গত এক সপ্তাহ ধরে মাছশূন্য অবস্থায় রয়েছে। গতকালও একই চিত্র দেখা গেছে। ফলে অলস সময় কাটাচ্ছেন ক্ষুদ্র থেকে বড় সব ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন, ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা পর প্রচুর মাছ ধরা পড়বে–এমন আশা ছিল সবার। আমরা মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু মাস পেরোলেও এখনো শূন্যই রয়ে গেছে ব্যবসা। এখন আমাদের অর্থ সংকট চলছে।
মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক, নুনিয়াছটা, পাশের খুরুশকুল, টেকনাফের জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ৩২টি জেলেপল্লিতে এখন হাহাকার অবস্থা চলছে। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে অর্থ সংকট।
বোটের মালিকরা জানান, কয়েক মাস ধরে সাগরে মাছ ধরা পড়ছে না। সাত–আট দিন সময়ের জন্য একটি ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে নামলে খরচ হয় ২–৩ লাখ টাকা। মাছ বিক্রি করে ১ লাখ টাকাও পাওয়া যায় না। লোকসান গুনতে গুনতে হয়রান ট্রলার মালিকদের পক্ষে জেলেদের আর্থিক সহায়তাও সম্ভব হচ্ছে না।
কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, সাগরে নিম্নচাপ অব্যাহত রয়েছে। এতে ঝড়ো বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। সাগরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাই আজও (গতকাল) কক্সবাজার উপকূলে ৩ নং সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সব ধরনের নৌযানকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে। রোববার পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় মাছ ধরা পড়েছিল হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ ছিল ৩৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। চলতি বছর ৩৬ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ ধরার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈরী পরিবেশের কারণে সাগরে ট্রলার নামতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।