শীতের সন্ধ্যায় হিম হাওয়া। উষ্ণতার টানে ঘরে ফিরছে পথিক। অথচ তখন নগরীর লালদীঘি পার্কজুড়ে ছিল কবিতার উষ্ণতা। যার আকর্ষণে কাব্যপ্রেমীরা ছুটে আসেন সেখানে। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) কবিতা পাঠের এ আয়োজন করে। সাথে ছিল পিঠা উৎসব। চারটি স্টলে সাজানো বাহারি সব পিঠা নাগরিক জীবনে মেলবন্ধন ঘটালো গ্রামীণ সংস্কৃতির।
বিকেল ৫টায় উৎসবের উদ্বোধন করেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এসময় উপস্থিত ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম, চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মফিদুল আলম।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, বাঙালির হৃদয় ও অস্তিত্বের শিকড়ে জড়িয়ে আছে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারির পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। তাই গুরুত্বপূর্ণ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনকে আয়োজনের জন্য বেছে নিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের মা-দাদীরা পিঠা বানিয়ে গ্রামীণ ও কৃষি সংস্কৃতিকে লালন করতেন। পিঠা উৎসবের মাধ্যমে সেটাকে নাগরিক জীবনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
প্রশাসক বলেন, আমরা আমন্ত্রণপত্রে ভিন দেশের ভাষা ব্যবহার করি। এটা হীনম্মন্যতার প্রকাশ। যাকে আমন্ত্রণ জানচ্ছি তার সাথে বাংলায় কথা বলি, কিন্তু তাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখছি কেন? যে ভাষায় কবিতা লিখি, যে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া সে ভাষায় চিঠি লেখা যায় না? তিনি বলেন, আমি ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে না। ভাষা হচ্ছে জ্ঞানের চাবি। হিব্রু, ফ্রেঞ্চ, আরবি, ল্যাটিন, ইংরেজি বা আরো ভাষা শিখুন। সমস্যা নেই। যত শিখবেন তত জানবেন। কিন্তু জীবনধারারায় নিজের মাতৃভাষাকে লালন করতে হবে।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমাদের রাজনীতির সঙ্গে অতীতে যে সংস্কৃতি যুক্ত ছিল, তার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন খোরশেদ আলম সুজন। ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে আমাদের রাজনীতির চেহারা ছিল এমনই। তখন একজন রাজনীতিবিদ শুধু রাজনীতিই করতেন না, কবিতাও পড়তেন, গানও ভালোবাসতেন। সেদিন রাজনীতি এবং সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল বলেই আমরা বাঙালির মূল চেতনাকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলাম। তিনি বলেন, কিন্তু আজ বড়ই দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি অনেক দূরে সরে চলে গেছে। এজন্য একটি সংস্কৃতিবিহীন বন্ধ্যা রাজনৈতিক পরিবেশে এখন আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলা ও বাঙালির মনন, বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ এবং এর সঙ্গে সবার সম্মিলন ঘটানোর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুজন চালু করেছেন, আগামীদিনে যিনি মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে আসছেন, তিনিও সেই সাংস্কৃতিক ধারা অনুসরণ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
এদিকে অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ গান দুটি পরিবেশন করে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই প্রতিষ্ঠানের দুই ছাত্রী ঐশি লক্ষ্মী ও অনন্যা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘কলির কথা শুনে বকুল হাসে, কই তাহার মতো আমার কথা শুনে হাসো না তো…’ ছিল বাড়তি আকর্ষণ।
এরপর শুরু হয় কবিতা আবৃত্তি। প্রথমে কবি রাশেদ রউফ আবৃত্তি করেন ‘আমার স্পর্ধা আমার অহংকার’ শিরোনামের কবিতা। এরপর খালিদ আহসান ‘বয়স্কা’ ও ‘বয়সরেখা’, আকতার হোসাইন ‘আরেকটি ফাল্গুনে’ ও ‘আবোল তাবোল’, ইউসুফ মোহাম্মদ ‘তর্পণ’, আনন্দ মোহন রক্ষিত ‘চেরাগীর অপূর্ব আলোয়’, আবুল কালাম বেলাল ‘ঐ ডাকে ভোর পাখি’, মনিরুল মনির ‘অভিপ্রায়’ ও ‘অন্তঃপুর’, ড. মোহীত উল আলম ‘বধ্যভূমি’, বিজন মজুমদার ‘দাও মোদের নির্বাসনে’, সাথী দাশ ‘স্বাধীনতা’, আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী ‘রাষ্ট্রভাষা’, অরুণশীল ‘মানববন্ধন’, সাইফুদ্দিন সাকিব ‘একুশ আসে’, আবু তসলিম ‘মুজিব মানে বাংলাদেশ’, লিটন কুমার চৌধুরী ‘শীতে হিম লেগেছে’, গোফরান উদ্দীন টিটো ‘জাতির জনক’, হোসাইন কবির ‘পুরাতন নদী’, খালেদ হামিদী ‘আমার জন্মের দাগ’ ও ‘চিঠি’, খুরশিদ আনোয়ার ‘একজন কবির প্রার্থনা’ এবং আশীষ সেন ‘জলযোগের বন্ধুরা আমার’ শিরোনামে কবিতা আবৃত্তি করেন।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া পাঠ করেন আহমেদ মনসুর ও তালুকদার হালিম। তারা পাঠ করেন ‘সোনাইয়্যার মার করোনা ভাবনা’, ‘ইভটিজিং’। বিপুল বড়ুয়া ‘জ্যোৎস্না নামে’, ‘কেনে চলর’ ‘নাতিন গেইয়্যি’ ও ‘তালতো বোন’ শিরোনামে ছড়া পাঠ করেন।