নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমার মা আলহাজ্ব নূর বেগম–এর মাঝে তাঁরই প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পেতাম। এলাকার দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা মহিলাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে নিজ বাসায় গড়ে তোলেন সেলাই ও সূঁচি কর্ম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পরবর্তীতে এটা ছড়িয়ে দেন চট্টগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলার নানা প্রান্তে। এখান থেকে হাতের কাজ শিখে নতুন করে বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পায় অনেক অসহায় নারী। আমার মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে সে সময় তাঁরই সুদক্ষ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পায় ‘কর্মজীবী ও দুস্থ নারী কল্যাণ সমিতি’, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি’ ও ‘চট্টগ্রাম মাদার্স ক্লাব’। এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আশির দশকে বেশ সাড়া ফেলে। সমাজের অসহায়, দুঃস্থ, নির্যাতিতা মহিলাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। তাদের অন্যতম একটি সাড়াজাগানো সামাজিক উদ্যোগ ছিল, যৌতুক বিহীন বিয়ের আয়োজন। কর্মজীবী ও দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতির ব্যানারে সেসময় প্রায় অর্ধ শতাধিক দুস্থ পরিবারের মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হয়। একইদিনে একসাথে ১০ জন মেয়ের বিয়ের আয়োজনের রেকর্ডও রয়েছে। এমনই এক আয়োজনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমএ মান্নান সাহেব উপস্থিত থেকে কন্যা সমপ্রদান করেন এবং নবদম্পতির কাছে একটি করে রিক্সা ও সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উপহার হিসেবে তুলে দেন।
তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি নির্যাতিত মহিলাদের আইনি সহযোগিতা দিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘মহিলা আদালত’। যার প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। শুধু চট্টগ্রাম শহরে তাঁদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল না। উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে দুর্গম এলাকায় জীবনের ঝুঁকির পরোয়া না করে সশরীরে গিয়ে নির্যাতিত গৃহবধূকে উদ্ধারের রেকর্ডও রয়েছে। অনেক সংসারকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ‘মহিলা আদালতে’র কার্যক্রম নিয়ে সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশেষ সাক্ষাৎকার পর্ব ও রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২০নং দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন এলাকার সার্বিক উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত থাকার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে কোরবানীগঞ্জ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সানফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন’, যা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার শিশুদের মাঝে শিক্ষার প্রদীপ্ত বীজ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি রাজনীতির জটিল রাস্তায়ও তাঁর পথচলা দেখেছি। জাতীয় মহিলা পার্টি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। মানুষের কল্যাণই তাঁর চির আরাধ্য ছিল।
নিজ পিতা বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী, পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী ছৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ (রাঃ) এর প্রধান খলিফা, ৩৫নং বক্সিরহাট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (রাঃ) এর পদাংক অনুসরণ করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সমাজ দরদী মানবিক মানুষ হিসেবে। ছোটবেলা থেকে মাকে দেখেছি নানাজানের ছায়া সঙ্গী হয়ে থাকতে।
মা সবসময় বলতেন আমার মরণ যেন হয় বৃহস্পতিবার রাতে এবং বাদে জুমা আমার মুরশিদ কেবলার হাতেই যেন শেষ বিদায় হয়। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর কথাটিই শুনলেন এবং কবুল করে নিলেন। সপ্তাহখানেক মুমূর্ষু অবস্থায় থেকে ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর ঠিক বৃহস্পতিবার রাতটাই বেছে নিলেন তিনি। রাত দু‘টোয় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকিরে ঠোঁট মিলিয়ে কালেমা মুখে মা আমার শেষ নিঃশ্বাসটুকু ত্যাগ করলেন। পরদিন শুক্রবার বাদে জুমা ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে লাখো লাখো মুসল্লীর উপস্থিতিতে হুজুর কেবলা আল্লামা তাহের শাহ্ (ম.জি.আ.) ইমামতিতে নামাজে জানাজার মাধ্যমে শেষ বিদায়। (ঐদিন বাদে আসর হুজুর কেবলা বাংলাদেশ ছেড়ে যান)। এমন সৌভাগ্য ক’জনার হয়! নেককার বান্দাদের মনের বাসনা হয়তো আল্লাহ্ এভাবেই পূরণ করেন।
সুন্দর সুদীপ্ত সমাজ গড়ার লড়াইয়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আমার মাকে ২০১৪ সালে সমাজসেবায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করা হয়।
আজ মা নেই। মা’র গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি আমাদের চলার পথের পাথেয়। আমি মনে করি, মরহুম আলহাজ্ব নূর বেগমের মতো মহীয়সী নারীদের আলো ছড়ানো পথেই নিহিত এই ঘুণে ধরা সমাজের মুক্তির পথ।












