মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াাদ : কুদরতে ইলাহীর অনন্য নিদর্শন

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২৪ জুন, ২০২২ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

নবী করিম (সা.) বলেছেন, রোকনে আসওয়াাদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেশতের দুটো ইয়াকুত পাথর। আল্লাহ এই দুটি পাথরে নূর মিশিয়ে দিয়েছেন। এগুলোর আলোতে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ড আলোকোজ্জ্বল হয়ে যেত। (সুনানে তিরমিজি) অনেক হজযাত্রী মক্কায় এসে মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) নামাজ আদায়ের পাশাপাশি হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম দেখছেন।

হজের সঙ্গে রয়েছে বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এবং তদীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর সম্পর্ক। আল্লাহর নির্দেশে তিনি কাবাগৃহ পুনর্র্নিমাণ করেন। জান্নাতের একটি পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি কাবাগৃহের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এ পাথরটি প্রয়োজন সাপেক্ষে ইব্রাহিম (আ.) কে উপরে তুলে ধরত, আবার যখন ইব্রাহিম (আ.)-নিচে কাজ করতেন, তখন পাথরখানা নিচে নেমে যেত। ইব্রাহিম (আ.)-এর পবিত্র পায়ের ছাপ এখনো পাথরের গায়ে দেখা যায়। হাজীরা মাকামে ইব্রাহিমের পাশে দাঁড়িয়ে যে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন এই দুই রাকাত নামাজ হজের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। মাকামে ইব্রাহিম বলতে সেই পাথরকে বুঝায় যেটা কাবা শরিফ নির্মাণের সময় ইসমাইল (আ.)-নিয়ে এসেছিলেন, যাতে পিতা ইব্রাহিম (আ.)-সেটির ওপর পা রেখে কাবা ঘর নির্মাণ করতে পারেন। ইসমাইল (আ.)-পাথর এনে দিতেন, ইব্রাহিম (আ.)-তার পবিত্র হাতে তা কাবার দেওয়ালে রাখতেন।

কাবা শরিফের পাশেই চারদিকে লোহার বেষ্টনীর ভেতর একটি ক্রিস্টালের বাঙে আছে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান-প্রায় এক হাত। এটিই মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান। মাকামে ইব্রাহিমের কাছে বা ঘেঁষে অনেক মুসল্লি নামাজ পড়েন। হজরত উমর (রা.) এর সময় পাথরটিকে সরিয়ে বর্তমান জায়গায় বসানো হয়। মাকামে ইব্রাহিমের কাছে অনেক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন, অনবরত চলে তাওয়াফ।

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর শেষ জীবনের ইবাদতের স্থান মাকামে ইব্রাহিম। এর প্রতিটি অনুকণা খলিলুল্লাহর অশ্রু ধারায় সিক্ত বা সিঞ্চিত। হজ ও উমরা পালনকারীরা তাওয়াফ শেষে এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে পাপমুক্তি ও স্বীয় মনোবাসনা কামনা করে মোনাজাত করেন। সাধারণ মূল্যহীন পাথরটি হযরত ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর সংস্পর্শে এসে অনন্য মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।

কাবা ঘরের চারটি কোণের আলাদা নাম আছে। যেমন হাজরে আসওয়াদ, রকনে ইরাকি, রকনে শামি ও রকনে ইয়েমেনি। হাজরে আসওয়াদ বরাবর কোণ থেকে শুরু হয়ে কাবাঘরের পরবর্তী কোণ রকনে ইরাকি, তারপর মিজাবে রহমত, এরপর হাতিম। হাতিম হলো কাবাঘরের উত্তর দিকে মানুষ সমান অর্ধবৃত্তাকার উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান। তারপর যথাক্রমে রকনে শামি ও রকনে ইয়েমেনি। এটা ঘুরে আবার হাজরে আসওয়াদ বরাবর এলে তাওয়াফের এক পাক পূর্ণ হয়। এভাবে সাত পাক দিতে হয়। হাজরে আসওয়াদ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার উঁচুতে রাখা। প্রতিবার চক্করের সময় এতে চুম্বন করতে হয়।

হাজরে আসওয়াদের আভিধানিক অর্থ কালো পাথর। মুসলমানদের কাছে এটি অতি মূল্যবান ও পবিত্র। আগে এটি ছিল আস্ত একটা পাথর। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরাগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। হাজরে আসওয়াদ নিয়ে একটি ঘটনা সবার কম-বেশি জানা। তা হলো, পবিত্র কাবাঘর পুনর্র্নিমাণের পর হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন-এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্র-প্রধানকে চাদর ধরতে বলেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।

কালো পাথর চুম্বনের তাৎপর্য : আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন। পাথর চুম্বনের দ্বিতীয় তাৎপর্য হচ্ছে-একই পাথরে একই স্থানে লাখ লাখ হাজীর চুম্বনে ভেঙ্গে যায় উঁচু নিচুর বিভেদের জঘন্য প্রাচীর। এই শুভ লগ্নে বিশ্বের হাজীরা বিশ্বভ্রাতৃত্বে একত্রিত হয়। মালেকী, হাম্বলী, হানাফী, শাফেয়ী, শিয়া-সুন্নী বিভিন্ন মাজহাবের প্রাচীর খান খান হয়ে ভঙ্গে সবার মুখ, হাত। এক মুখ, হাত হয়ে যায়। কেউ কাউকে ঘৃণা করে না। একজনের চুম্বনের জায়াগায়া অন্যজন চুম্বন দিতে অস্বীকার করে না। নবীর পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করতে পাথরটি স্বর্ণ, রূপা ও গ্লাসের ফ্রেমে আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইব্রাহিমের দূরত্ব ১৪ দশমিক পাঁচ মিটার। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দু’রাকাত সালাত আদায় করতে হয়।

হাজরে আসওয়াদের মর্যাদা : একটি হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তা’আলা কেয়ামতের দিন পাথরটি পুনরুত্থান করবেন। সে দুই চোখ দিয়ে দেখবে। নিজের জিহ্‌বা দিয়ে কথা বলবে। তখন যারা তাকে চুমু দিয়েছিল তাঁদের জন্য দোয়া করবে। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ৯৬১, ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর : ২৯৪৪) জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) মক্কায় এসে হাজরে আসওয়াদের কাছে আসেন। অতঃপর তা স্পর্শ করে এর ডান দিকে হাঁটা শুরু করেন। তিন বার হালকা দৌঁড়ান ও চার বার হাঁটেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ১২১৮) ফ্রেমে মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়।

হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষের গোনাহ যদি হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিমের পাথরকে স্পর্শ না করতো, তাহলে যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি তা স্পর্শ করলে (আল্লাহর পক্ষ হতে) তাকে সুস্থতা দান করা হতো।-সুনানে কুবরা, বায়হাকি : ৫/৭৫ ; শরহুল মুহাযযাব : ৮/৫১।

নবীজি চুম্বন করার কারণে হাজরে আসওয়াদের মর্যাদা : আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা ও সম্মানের কারণে হাজরে আসওয়াদ ও মাক্বামে ইব্রাহিম বান্দার জন্য উপকারী। সুতরাং এতে চুম্বন করাও সওয়াবের কাজ। এটি দুআ কবুলের বরকতময় স্থান। (মিরআতুল মানাজীহ, ৪র্থ খণ্ড) হে আল্লাহ আমাদের সকলকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর হিদায়ত সকলকে নসীব করুন। পাপমুক্ত জীবন নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারাই হবে এ পাথর স্পর্শ ও চুম্বনের উত্তম প্রতিদান। রাহমানুর রাহিম আল্লাহতায়াালার কাছে ফরিয়াাদ জানাচ্ছি, তিনি যেন স্মৃতিবিজড়িত হাজরে আসওয়াাদ ও মাকামে ইব্রাহিম জান্নাতি দুটি পাথরকে চুম্বন করার ও মাকামে ইব্রাহিমের পাশে দু রাকাআত নামাজ পড়ার তাওফিক দান করেন। আমিন।

লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস,
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের সেতু
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা