বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে ‘লোকসাহিত্য’ শীর্ষক সংকলনের চতুর্দশ খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডের সম্পাদক ও ভূমিকা লেখক আলমগীর জলীল। গ্রন্থটিতে মাইজভাণ্ডারি গান হিসেবে ২৫টি গান লিপিবদ্ধ করা হয়। গানগুলোর মধ্যে ১৩টিই মাওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীর (১৮৭০–১৯০৫)। অন্য গানগুলো ইব্রাহিম, আব্দুল্লাহ, জলিল, মকবুল ও আহাম্মদ রহমানের।
মকবুল হলেন সৈয়দ আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (১৮৬৪–১৯২৭)। তিনি ‘মাওলানা হাফেজ আবদুল ওহাবের তনয় ও মাওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা’। জলিল বলতে চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ গ্রামের শাহ্ আবদুল জলিল সিকদারকেই (১৮৫৭– ১৯৩৪) বোঝানো হয়েছে, যিনি জাহাঁগিরিয়া তরিকার প্রবর্তক ‘শেখ মোখলেছুর রহমানের পুত্র আবদুল হাইর কাছে শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে… জাহাঙ্গীরিয়া তরিকার অনুসারী হন’। জলিল শেখ মোখলেছুর রহমানের (১৮১৪, মতান্তরে ১৮১২–১৮৮৪–৮৫) স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি মূলত জাহাঁগিরিয়া তরিকাভিত্তিক গানের গীতিকার। প্রচুর গান রচনা করেন এবং গানের কয়েকটি সংকলনও প্রস্তুত করেন। ‘প্রভু পরিচয়’, ‘শহিদে এমাম’ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ‘শহিদে এমাম’ সংকলনটির অন্য নাম ‘জারী গান’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য শাখায় সংকলনটির একটি পাণ্ডুলিপি ‘ৎারী গান’ নামে সংরক্ষিত আছে। জলিল সিকদার একাধিক পুথিও রচনা করেন। যেমন, ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’ ও ‘জাহাঁগীর চরিত’ প্রভৃতি। ‘জাহাঁগীর চরিত’ পুথিটির অন্য নাম ‘জাহাঁগীর চরিত ও বারমাসী’। পুথিটির একটি পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য শাখায় ‘জাহাঁগীর চরিত ও বারমাসী’ নামে সংরক্ষিত আছে। আহাম্মদ রহমান, ইব্রাহিম ও আব্দুল্লাহর পরিচয় আপাতত আমাদের জানা নেই। লিপিবদ্ধ হওয়া জলিল ও আহাম্মদ রহমানের দুটি গান মাইজভাণ্ডারি গান নয়। এই দুটি গান জাহাঁগিরিয়া তরিকাভিত্তিক। তাহলে সংকলনটিতে মাইজভাণ্ডারি গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩। ২৩টি গানই উচ্চভাবসম্পন্ন ও তত্ত্বসমৃদ্ধ। আলমগীর জলীল এই মাইজভাণ্ডারি গানগুলোর ‘মাইজভাণ্ডারী গান’ শিরোনামে যে–ভূমিকা রচনা করেছেন, তার অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো:
“মাইজভাণ্ডার চট্টগ্রাম সদর মহকুমার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এইখানে কাদরিয়া তরিকার বড়পীর গওসল আজম হজরত আব্দুল কাদির জিলানী (১০৭৭–১১৬৬) সাহেবের কতিপয় মুরীদের মাজার রয়েছে। তাঁরাও কাদরিয়া তরিকাভুক্ত ওলি–আল্লা বা তাপস। এইখানেই গড়ে উঠেছে অধ্যাত্মসাধনায় নিবেদিতপ্রাণ সাধকদের আস্তানা। প্রতি বৎসর একটা নির্দিষ্ট দিনে ঐ স্থানে বিরাট মহফেল বসে। মহফিলে হলকা–জিগির বা উচ্ছেস্বরে নাম জপক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। পরে গজল গান চলে। খোদা, রসুল ও পীর–মুর্শিদের মাহাত্ম্য কীর্তন এ গানের বিষয়বস্তু। এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, রচয়িতার নামে গানের নামকরণ না হয়ে স্থানের নামে গানের নামকরণ হয়েছে। সে কারণ, ফকির–দরবেশ বা পীরের নামানুসারে গানের নামকরণ না হয়ে মাইজভাণ্ডার নামক স্থানে উদ্ভব বলে এ গানের নাম মাইজভাণ্ডারী গান।
কাল বা সময়: হজরত বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী সাহেবের জীবনকাল ১০৭৭–১১৬৬ খ্রীঃ পর্যন্ত। তিনি বাগদাদের অন্তর্গত জিলান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঐখানেই দেহত্যাগ করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর থেকে তাঁর বংশধর ও মুরিদগণ বিভিন্ন দেশে কাদরিয়া তরিকার আদর্শবাদ প্রচারে ব্রতী হন। তাঁর এক পুত্র মেদিনীপুর জেলায় আগমন করেন এবং কলকাতা শহরে একটি খান্কা প্রতিষ্ঠা করেন। হজরত বড় পীরের একজন শিষ্য চট্টগ্রাম শহরের মাইজভাণ্ডার নামক স্থানে এসে আস্তানা স্থাপন করেন। বস্তুত:, ভারত–বাংলা উপমহাদেশে মুসলিম আগমনের সাথে সাথে পীর–আওলিয়াগণ তাঁদের শিষ্যদের মধ্যে হলকা জিকির ও গজল গানের ধারা প্রবর্তন করেন। মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভব কালের প্রাচীন ইতিহাসও এ ধারায় পড়ে। মুসলিম শাসন আমলে মুসলিম সুফী সাধক ও তাঁদের অনুসারী ভক্তগণ আরবী ও ফারসী ভাষা মাধ্যমে তাঁদের জিকির ও গজলগুলি গাইতেন। পরবর্তীকালে এগুলির ধারা প্রবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় রূপ নেয়। সে কারণ, আজো গবেষণা দ্বারা দেখা যায় মাইজভাণ্ডারী ফকির সমপ্রদায়ের মধ্যে আরবী, উর্দু ও ফারসী ভাষার সাথে সাথে বাংলা ভাষার গান ও গজল প্রচলিত আছে। মধ্যযুগের গীতি কবিতা অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল পদাবলী, ভাবগান, ধুয়াগান, ধুয়াজারী প্রভৃতি গানের উৎপত্তির সমকালীন এই মাইজভাণ্ডারী গান।
অনুষ্ঠান: মজলিস করে পীর গওসল আজমের মুরিদগণ সমবেত হন। তারপর তাঁরা কোরাস সুরে জিকির ও গজল শুরু করেন। প্রথমদিকে জিকির চলে। পরে গজল গীত হয়। গায়ক ও শ্রোতাগণ এ গানে এতই মত্ত হন যে, তাঁরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আল্লার আশ্কে ক্রন্দন করেন। সমস্ত মজলিস এক ঐশী আমেজে ভরপুর থাকে।
বাদ্যযন্ত্র: এই গানে সাধারণত: কোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় না। তবে, আজকাল দোতরা, একতরা, ডুগী, খোল, করতাল নিয়েও কোথাও কোথাও এ গান গীত হয়।
পোশাক: গায়কগণ বিশেষ কোন পোশাক ব্যবহার করে না। পাঞ্জাবী, পাজামা, লুংগি, চাদর, টুপী প্রভৃতি পরিধান করে এ গান পরিবেশিত হয়।”
আলমগীর জলীল সম্ভবত মাইজভাণ্ডারি গান সম্পর্কে কোনো খোঁজ–খবর না করেই এই ভূমিকা রচনা করেছেন। ‘মাইজভাণ্ডার গ্রাম চট্টগ্রাম সদর মহকুমার অন্তর্গত একটি গ্রাম’ এবং ‘রচয়িতার নামে গানের নামকরণ না হয়ে স্থানের নামে গানের নামকরণ হয়েছে’ তথ্যদুটিকে সঠিক ধরে নিলে ভূমিকাটির বাকি তথ্যসমূহ বা বিবরণ একেবারে অগ্রহণযোগ্য ও বানোয়াট। বড়পীর গওসল আজম হজরত আব্দুল কাদির জিলানী, মেদিনীপুর জেলায় আসা তাঁর পুত্র এবং আব্দুল কাদির জিলানীর কতিপয় মুরিদের মাজারের সঙ্গে মাইজভাণ্ডারি গানের কোনো সম্পর্ক নেই। হজরত আব্দুল কাদির জিলানীর কোনো শিষ্যের মাইজভাণ্ডার গ্রামে আস্তানা স্থাপন করার কোনো ইতিহাসও নেই। আলমগীর জলীল মাইজভাণ্ডারি গানের যে–সময় নির্ধারণ করেছেন অর্থাৎ তিনি যে বলেছেন, মধ্যযুগের গীতি কবিতা প্রভৃতির উৎপত্তির সমকালীন এই মাইজভাণ্ডারি গান, তাও ঠিক নয়। তাঁর ভূমিকার ‘অনুষ্ঠান’ ও ‘বাদ্যযন্ত্র’ অনুচ্ছেদ দুটির তথ্যগুলোও কোনোভাবে সত্য নয়। ‘পোশাক’ অনুচ্ছেদের কথাগুলোও গড়পড়তা বলা হয়েছে। আমাদের সংগৃহীত নিম্নোক্ত তথ্যাদি পাঠ করলে আলমগীর জলীলের ভূমিকাটি যে ভুল ও মনগড়া, তা ধরা পড়বে:
‘ভারত–বঙ্গে (বা পাক–ভারতে) সূফীমতের আবির্ভাবের পর, অনেকগুলো সূফীমতের প্রচার–প্রসার ঘটে। তবে চারটিই প্রধান ১.চিশতিয়া ২. কাদেরিয়া ৩. সোহরওয়ার্দীয়া ৪. নকশবন্দিয়া। প্রথমে চিশতিয়া এবং সোহরওয়ার্দীয়া, পরে নকশবন্দিয়া এবং আরও পরে কাদেরিয়া’ প্রচার–প্রসার লাভ করে। ‘প্রচারিত অন্যান্য সূফীমত এগুলো থেকে উদ্ভূত।… শাত্তারিয়া, মদরিয়া, কলন্দরিয়া ইত্যাদি এই চারটির উপমত’।
‘মাইজভাণ্ডারি মূলত কাদেরিয়ার উপমত’। ‘চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সাধক সৈয়দ আহমদুল্লাহ (০১ মাঘ, ১৮২৬–১৯০৬) উক্ত গ্রামে মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন’ করেন। এই তরিকা গানাশ্রয়ী। মাইজভাণ্ডার গ্রামে প্রবর্তিত হওয়ায় এই তরিকার নাম মাইজভাণ্ডারি তরিকা এবং একে কেন্দ্র করে রচিত গানের নাম মাইজভাণ্ডারি গান। সৈয়দ আহমদুল্লাহর নির্দেশে সূচনাপর্বের গীতিকাররা বাংলা ভাষায় মাইজভাণ্ডারি গান রচনা শুরু করেন। এই গানে খোদা, নবী, মুরশিদ ও গদিনশীন পীরের প্রশংসাই প্রাধান্য পায়। তরিকাটির সাধনার মূলনীতি হলো: গানবাদ্য সহকারে নৃত্য করা। এই গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাইজভাণ্ডারি পরিমণ্ডলের সামা মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গান পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠান ছাড়াও এই গান পরিবেশন করা যায়। এই গান পরিবেশনে প্রয়োজন নেই বিশেষ পোশাকের। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশে, এমনকি বাংলাদেশের বাইরে আজও লক্ষ লক্ষ লোক মাইজভাণ্ডারি তরিকার অনুসারী ও মাইজভাণ্ডারি গানের ভক্ত।
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ‘১২৭০ হিজরীতে যশোর জেলার কাজীপদে… স্বইচ্ছায় ইস্তফা’ দিয়ে কলকাতা মুন্সী বো–আলী মাদ্রাসায় ‘মোদার্রেছি কার্যভার গ্রহণ’ করে শিক্ষকতা শুরু করেন। ইতোমধ্যে তিনি পাঞ্জাবের লাহোর নিবাসী সৈয়দ দেলোয়ার আলী ও সৈয়দ আবু শাহামা মোহাম্মদ সালেহ–এর সান্নিধ্যে এসে দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তিকে মুরশিদ বা পীর হিসেবে গ্রহণ করে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে সিদ্ধি অর্জন করে মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন–প্রচার–প্রসারে এগিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য, তিনি কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।
১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে পটিয়া উপজেলার হুলাইন গ্রামের আবদুস সাত্তার চৌধুরী সংগৃহীত উল্লিখিত ২৫টি গান নিয়ে আলমগীর জলীলের ‘মাইজভাণ্ডারী গান’ শিরোনামে মনগড়া ভূমিকা রচনা করা কতটুকু সঙ্গত হয়েছে, পাঠকেরাই বিচার করবেন।