মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মেঘনাদবধ কাব্য

ড. নারায়ন বৈদ্য | শুক্রবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

২য় সর্গ: অস্ত্রলাভ

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ধীরে ধীরে পার্থিব জগতের জীবকুল ঘুমে আচ্ছন্ন হলো। এমন সময় লংকাপুরী রাজদেবী লক্ষ্মী কমলা যিনি রাজ প্রাসাদে থাকতেন, তিনি স্বর্গপুরীতে দেব রাজের সভায় উপস্থিত হলেন। দেবতা ইন্দ্র তার স্ত্রী সচিদেবীকে সাথে নিয়ে স্বর্ণের সিংহাসনে বসে আছেন। দেবী লক্ষ্মীকে দেখে ইন্দ্র অতি সম্মানের সঙ্গে জানতে চাইলেন, তিনি কেন তার কাছে আসছেন। তখন দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রকে বললেন, লংকায় আমি বহুদিন ধরে আছি। রাবণের নিজের কর্ম দোষে তার বংশ ধ্বংস হবে, এ তার নিয়তি। আমার কিছুই করার নেই। অথচ আমি যে তাকে ছেড়ে চলে আসব সেই উপায়ও নেই। কারণ রাবণ যতদিন জীবিত থাকবে আমাকে ততদিন লংকাপুরীতে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে রাবণের সকল বীর যোদ্ধা যুদ্ধে মারা গিয়েছে। একমাত্র বেঁচে আছে বীর মেঘনাদ। রাবণ আজ মেঘনাদকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করেছে। কাল মেঘনাদ রামের সাথে যুদ্ধ করবে। সে আজ নিকুম্ভীলা যজ্ঞাকারে ইস্ট দেবির পূজা করছে। কালকের যুদ্ধে রামের যে কি হবে তা বলা মুসকিল। কারণ এখন পর্যন্ত যুদ্ধে কেউ মেঘনাদকে হারাতে পারেনি। রামচন্দ্র, যেহেতু সকল দেবতাদের অত্যন্ত প্রিয়, সেহেতু রামকে অবশ্যই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কিভাবে তাকে বাঁচানো যাবে তা ভেবে চিন্তে করা হবে। লক্ষ্মী দেবীর মুখে এ কথা শুনে ইন্দ্র কিছুটা ভয় পেয়ে তার স্ত্রী সহ কৈলাস পর্বতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কারণ কৈলাসে শিব এবং দেবী দুর্গা আছেন। তারা রামকে বাঁচানোর একটি ভাল উপায় বের করতে পারবেন। এদিকে কৈলাসে মহাদেব শিব ছিলেন না। তিনি যোগাসন ছেড়ে পাহাড়ের চূড়ায় এসে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। এ স্থানটি ঘন কুয়াশায় আবৃত্ত ছিল। কৈলাসের সিংহাসনে দেবী দূর্গা বসে আছেন। ইন্দ্র সন্ত্রীক সেখানে উপস্থিত হয়ে দেবী দুর্গাকে প্রণাম করে রাম ও রাবণের যুদ্ধের কথা বর্ণনা করে রামকে বাঁচাতে অনুরোধ করলেন। রাজা রাবণ যেহেতু শিবভক্ত অর্থাৎ শিব পূজা করেন এবং মহাদেব শিবও এখানে উপস্থিত নেই তাই দুর্গা এ ব্যাপারে ইন্দ্রকে সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু ইন্দ্র ও তার স্ত্রী সচিদেবী অনেক অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন রামকে বাঁচানোর জন্য। ঠিক এ সময় রামচন্দ্র লংকাপুরী থেকে দেবী দুর্গার পূজা করতে লাগলেন। পূজা পেয়ে খুশি হয়ে, ইন্দ্র ও সচি দেবীর অনেক অনুরোধে দেবী দূর্গা রাজী হলেন, শিবের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলতে। ধ্যানরত শিবের কাছে যাওয়ার জন্য দূর্গা কামদেবের স্ত্রী রতির মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে নিজকে সজ্জিত করলেন, তারপর কামদেব মদনকে সাথে নিয়ে দেবী শিবের কাছে পৌঁছালেন। কামদেব ফুল শর ছুড়ে ধ্যানরত শিবের ধ্যান ভাঙ্গালেন। তারপর শিব চোখ মেলে তার স্ত্রীকে এত সুন্দরভাবে সজ্জিত দেখে অভিভূত হয়ে বললেন, দেবি কেন এসেছো তা শিব জানে। বললেন, যদিও রাবণ তার ভক্ত তারপরও রামের স্ত্রীকে জোর করে ধরে নিয়ে আটকে রাখার অপরাধে তার পরিণাম রাবণকে ভোগ করতে হবে। এজন্য মহাদেব শিব দেবি দূর্গাকে বললেন, মায়া দেবির নিকট ইন্দ্রকে পাঠিয়ে রামকে বাঁচানোর পরামর্শ দিলেন। মায়া দেবির ক্ষমতায় রামচন্দ্রের ভাই লক্ষণকে দিয়ে মেঘনাদকে হত্যা করাবেন। শিবের এ কথা শুনে দেবি দূর্গা তড়িৎগতিতে কামদেব মদনকে পাঠিয়ে দিলেন ইন্দ্রের কাছে খবর পৌঁছে দিতে। মদন দেব এসে ইন্দ্রকে এ কথা জানালে ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ মায়া দেবীর নিকট গিয়ে সমস্ত কথা খুলে বললেন। সমস্ত ঘটনা শুনে মায়া দেবী মেঘনাদকে হত্যা করার জন্য দেব সেনাপতি কার্তিককে কিছু অস্ত্র ইন্দ্রের কাছে দিয়ে বললেন, মেঘনাদকে কিভাবে হত্যা করবে সেটা কাল সকালে লক্ষণকে বলবেন। আর মেঘনাদকে হত্যা করলে রাবণ ভীষণ দুর্বল হয়ে যাবে। তখন রাবণকে হত্যা করা সহজ হবে। আর রাবণকে হত্যা করলে সহজেই রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে পারবে। মায়া দেবির নিকট থেকে সেই সব অস্ত্র নিয়ে ইন্দ্র চলে আসলেন। ইন্দ্র চিত্ররথ নামক একজন দূতকে বললেন, এ অস্ত্রগুলো নিয়ে লংকাপুরীতে গিয়ে রামকে দিয়ে আসতে। বলতে বললেন, সকল দেবতারা রামের সাথে আছেন। রাম যেন কোন প্রকার চিন্তা না করে। তখন ইন্দ্র বাতাস, মেঘ, বজ্রকে বললেন, ঝড় বৃষ্টি শুরু করতে যেন লংকার পাহাড়রদার রাক্ষসরা ঘরে চলে যায় এবং দূত চিত্ররথকে যেন কেউ দেখতে না পায়। ইন্দ্রের কথামত লংকাপুরীতে তুমল ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো, চিত্ররথ সেখানে পৌঁছে রামচন্দ্রের সাথে দেখা কররেন এবং অস্ত্রগুলো বুঝিয়ে দিলেন। রামচন্দ্র এতে খুব খুশি হলেন। তারপর চিত্ররথ সেখান থেকে চলে আসলে লংকাপুরীর ঝড় বৃষ্টি বজ্র থেমে যায়। তখন রাক্ষসরা পূর্বের মত লংকা রাজ্য পাহারা দিতে লাগল। (চলবে)

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তির যুগে দ্বীনি চেতনা: মুসলমানের দায়িত্ব
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা