মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মেঘনাদবধ কাব্য

ড. নারায়ন বৈদ্য | বুধবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্য জগতে অমৃতাক্ষর ছন্দের প্রণেতা এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে কবির ভূমিকা অসীম তিনি হচ্ছেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যশোরের সাগর দাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এ কবির মহা সৃষ্টি মেঘনাদ বধ কাব্য। বিস্ময় সৃষ্টিকারী এ কাব্যের মর্মকথাগুলো নিয়ে কয়েকটি পর্বে সাজানো হয়েছে এ লেখাটি। এই লেখাটিতে আমার নিজস্ব কোন চিন্তাধারার প্রয়োগ ঘটেনি। শুধুমাত্র মহাকাব্যটিতে যা লেখা আছে তাই উপস্থাপন করেছি। পার্থক্য শুধু প্রকাশ মাধ্যম। মহাকবি মেধনাদবধ মহাকাব্যটি প্রকাশ করেছে অমৃতাক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করে। আর এ লেখায় তা গদ্য রীতিতে প্রকাশ করা হয়েছে। মহাকাব্যটিতে নয়টি সর্গ আছে। প্রতিটি সর্গের একটি করে নাম আছে।

মেঘনাদবধ কাব্য

(কাব্যে বর্ণিত কাহিনীর পূর্বের রামায়ণের কাহিনী সম্পর্কে জানা প্রয়োজন)

অযোধ্যায় দশরথ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর তিনশ’র বেশি রাণী ছিল। এতএত রাণীর মধ্যে তিন রাণী ছিল রাজার খুব পছন্দের। বড় রাণীর নাম ছিল কৌশল্যা, মেজ রাণী কৌকি এবং সেজ রাণী সুমিত্রা। তিন রাণীর চার পুত্র ছিল। রাণী কৌশল্যার পুত্র ছিল রাম। ইনি ছিলেন সবার বড়। মেঝ রাণী কৌকির ছেলে ছিল ভরত আর সেজ রাণীর দুই যমজ সন্তান লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন। লক্ষণ ছিল বড় ভাই রামের খুব প্রিয়। আর শত্রুঘ্ন ভালবাসতেন মেজ ভাই ভরতকে। সময় অতিক্রম হওয়ার পর এক রাজার বড় কন্যা সীতার সাথে রামের বিয়ে হয়। রাজা দশরথ বৃদ্ধ হলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বড় ছেলে রামকে সিংহাসনে বসাবেন। এদিকে মেজ রাণী কৌকির কাছে রাজা অনেক আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, মেজ রাণীকে তিনি ২ টি বর দিবেন। অর্থাৎ রাণী কৌকি যা ইচ্ছা দুইটি জিনিস চাহিবেন এবং রাজা তার ইচ্ছা পূরণ করবেন। রামকে সিংহাসনে বসানোর কথা শুনে রাণী কৌকি রাজা দশরথের কাছে দাবী জানালেন যে, আমি তোমার কাছে এতদিন যে দুইটি বর চাইনি তা এখন চাইবো। রাজা খুশি হয়ে সেই দুইটি বর জানতে চাইলে রাণী কৌকি বললেন, প্রথম বররামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে। দ্বিতীয় বরতার ছেলে ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে। যেহেতু রাজা কৌকিকে কথা দিয়েছিলেন সেহেতু রাজা দশরথ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি বড় ছেলে রামকে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাবেন। রামের সাথে তাঁর স্ত্রী সীতা এবং ছোট ভাই লক্ষণও বনবাসে চলে গেল। তারা পঞ্চবটি বনে ঘুরতে ঘুরতে দিন কাঠাতে লাগলো।

অন্যদিকে লংকার রাজা ছিলেন রাবণ নামে এক রাক্ষস। তার দশটা মুখ ও বিশটি হাত ছিল। তার বিধবা বোন সর্পনখা ঐ পঞ্চবটি বনের পাশে থাকতো। একদিন সর্পনখা এসে রামকে বললো, সে রামকে ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। নে রাম বললোআমিতো বিবাহিত। দেখছো না আমার স্ত্রী আমার সাথে আছে। বরং তুমি আমার ছোট ভাই লক্ষণকে বিয়ে কর। সে একা আছে। তখন সর্পনখা লক্ষণের কাছে গিয়ে লক্ষণকে একই প্রস্তাব দিল। লক্ষণ এর কথায় রাগান্বিত হয়ে তীর মেরে সর্পনখার নাক কেটে দিল। সর্পনখা কাঁদতে কাঁদতে বড় ভাই লংকার রাজা রাবণকে অভিযোগ করলো। এতে রাবণ অপমানবোধ করে রামের স্ত্রী সীতাকে হরণ করার সিদ্ধান্ত নিল এবং অশোক বনে আটকে রাখার জন্য স্থির করলো। রাম, লক্ষণ এ খবর জানতে পেরে বনের সকল পশু বিশেষ করে বানর ও হনুমানদের দিয়ে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল। উদ্দেশ্য ছিল লংকার রাজা রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করা। এভাবে শুরু হয়ে গেল রাম ও রাবণের যুদ্ধ।

মেঘনাদবধ কাব্য এখান থেকে শুরু

১ম সর্গঅভিষেক

লংকার রাজা রাবণ স্বর্ণখোচিত সিংহাসনে কাতর হয়ে বসে আছেন। কারণ রামের সাথে যুদ্ধে তার ভাই কুম্ভকর্ণ নিহত হয়েছেন। তারপরে তার বীরপুত্র বীরবাহু নিহত হয়েছেন। রাবণের ছিল তিন ভাই। রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ। কুম্ভকর্ণ একটানা ছয়মাস ঘুমিয়ে থাকে। কারণ এর আগে ঘুম ভাঙ্গলে তার মৃত্যু হবে। কিন্তু রাবণের সাথে রামের যুদ্ধ হওয়ার কারণে রাবণ তার ভাইকে ছয়মাসের আগে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। যার কারণে যুদ্ধে কুম্ভকর্ণের মৃত্যু হয়। কুম্ভকর্ণের মৃত্যুর জন্য রাজা রাবণ নিজকে দায়ী করে বিলাপ করছেন। এদিকে রাবণের ছিল দুই স্ত্রীমন্তদরী ও চিত্রাঙ্গদা। চিত্রাঙ্গদার পুত্র বীরবাহু এবং মন্তদরীর পুত্র মেঘনাদ। মেঘনাদের স্ত্রীর নাম প্রমিলা।

বীরবাহু যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে এক সৈন্য ভগ্নদূত (খারাপ খবর যে বহন করে আনে) হয়ে রাজার নিকট খবর পৌঁছে দিলেন। এতে রাজা রাবণ আরো কাতর হয়ে তার সভাসদদের নিয়ে প্রাসাদের চূড়ায় উঠলেন যুদ্ধের ময়দান দেখার জন্য। এখান থেকে রাবণ দেখতে পেলেন কিভাবে রামের সৈন্যরা রাবণের প্রাসাদ ঘিরে রেখেছেন। তিনি আরো দেখলেন হাজার হাজার মৃতদেহের সাথে তার প্রিয় পুত্র বীরবাহু পড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে রাজা বলছেন, জন্মভূমি রক্ষার জন্য যে ভয় পায় তাকে শত ধিক্কার জানাই। তার ছেলে বীরবাহু নিজ জন্মভূমি রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন এ বলে নিজকে সান্তনা দিচ্ছেন। এদিকে পুত্র শোকে কাতর চিত্রাঙ্গদা কাঁদতে কাঁদতে রাজা রাবণের নিকট এসেছেন এবং এসবের জন্য রাবণকে দোষারোপ করছেন। তিনি যদি রামের স্ত্রী সীতাকে হরণ না করতেন তবে এ যুদ্ধও লাগতো না এবং তার পুত্র বীরবাহুও নিহত হতো না। এসময় রাবণ চিত্রাঙ্গদাকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, এ যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তারা সবাই পুত্রতুল্য। তুমি মাত্র একজন পুত্রকে হারিয়ে এ রকম করছো। আমি শত শত পুত্রকে হারিয়েছি। তা হলে আমি কী অবস্থায় আছি। এরপর রাবণ সকল বীর যোদ্ধাকে হারিয়ে নিজেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য স্থির করলেন। এদিকে রাবণের অন্যপুত্র মেঘনাদ, স্ত্রী প্রমিলার সাথে প্রমোদ উদ্যানে ছিলেন। মেঘনাদ এ যুদ্ধের খবর তখনও জানেন না। তখন লক্ষ্মীদেবী রাবণের প্রাসাদে থাকতেন। লক্ষ্মীদেবী ধাত্রীমাতার রূপ ধরে মেঘনাদ এর নিকট গিয়ে যুদ্ধের কথা জানান। তাছাড়া বীরবাহু ও কুম্ভকর্ণের মৃত্যুর সংবাদ জানান। মেঘনাদ এ খবর শুনে বিস্মিত হলেন। মেঘনাদের হাতে একবার রাম মৃত্যুবরণ করেছিল। মেঘনাদ ভেবে পান না একজন মৃত মানুষ আবার জীবিত হয়ে কিভাবে যুদ্ধ করতে আসে। এ খবর শুনে মেঘনাদ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পিতা রাবণের নিকট এসে বলেন, আমি যুদ্ধে যাব এবং রামকে পরাজিত করে বেঁধে এনে আপনার পায়ে ফেলবো। আপনি সিংহাসনে বসে অপেক্ষা করুন। মেঘনাদের এ কথা শুনে রাবণ বলেন, তোমাকে যুদ্ধে পাঠাতে আমার মন সাই দিচ্ছে না।

কারণ আমি বুঝতে পারছি, দেবতারা যুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রামকে সহযোগিতা করছে। এমতাবস্থায় তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তবে এ রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি এ রাক্ষস কুলের ভরসা। মেঘনাদের অপর নাম ছিল ইন্দ্রজিৎ। কারণ দেবরাজ ইন্দ্রে সাথে যুদ্ধে মেঘনাদ ইন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন। এজন্য মেঘনাদকে ইন্দ্রজিৎ ও বলা হয়। মেঘনাদের এমন আগ্রহ দেখে রাবণ বললেন, তুমি যুদ্ধে যাও। তবে আগে অগ্নি দেবতার পূজা করে তবে যুদ্ধে যাও। আগামীকাল সকালে তুমি যুদ্ধে যেও। তখন রাজা রাবণ তার পুত্র মেঘনাদকে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করলেন। মেঘনাদের এমন সাঁজ দেখে চতুর্দিকে বাদ্য বাজানো শুরু হলো। জয় জয় রব ধ্বনিত হতে লাগলো।

(চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ,

গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএডগার অ্যালান পো : রহস্যের বরপুত্র ও আধুনিক ছোটগল্পের রূপকার
পরবর্তী নিবন্ধবড়দিন উপলক্ষে চট্টগ্রামে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা