আধুনিক বাংলা নাট্য সাহিত্যের সূচনা পর্বের কথা যদি বলি, তাহলে প্রথমে অনিবার্যভাবে যে নামটি আসে, তিনি হলেন মাইকেল মধুসুদন দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩)। অন্ধকার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর মূলোচ্ছেদ করে যিনি দেখিয়ে গেছেন নাটক কীভাবে লিখতে হয়, সংলাপের মধ্যে কেমন করে জীবন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে কেটেছে সারাটি জীবন। ইংরেজী সাহিত্যে বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সাধ পূর্ণ হলো না। একদা যেন স্বপ্ন দেখলেন ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন….।‘ এক একটি রতন দিয়েই মহাকান্ড ঘটিয়ে ফেললেন। একে একে লিখলেন মহাকাব্য, পত্রকাব্য, চতুর্দশপদী, পত্র সাহিত্য, নাটক আর কত কি। বিয়ে করলেন প্রথমে রেবেকা, পরে হেনরিয়েটাকে, মাইকেল যাঁকে ফরাসী উচ্চারণে সোহাগ করে ডাকতেন ‘আরিয়েন্ডা‘ বলে। সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি অপরিমিত মদ্যপান, বেহিসেবী জীবন যাত্রা। ৪৯ বছর বেঁচেছিলেন। অন্তিম মুহূর্তে তাঁর ‘এপিটাফ‘ আমাদের কাঁদায় ও ভাবায়– ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল…।‘ যে–সব সৃজনশীল ও মহৎ চরিত্রে নাটকীয় উপাদান থাকে, তাঁদের নিয়েই শুধু জীবনীমূলক নাটক লেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে এমনি এক চরিত্র মাইকেল মধুসূদন। আর এই চরিত্রে অভিনয় করে জগৎ জোড়া খ্যাতি পেয়েছেন বিশ শতকের কিংবদন্তী অভিনেতা, নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী (১৮৮৯–১৯৫৯)। তাঁর অভিনয় ক্ষশতা এতই অসাধারণ ছিল যে, তিনি ‘বাংলার গ্যারিক‘ উপাধী পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, সুরচিসম্পন্ন এবং কলেজের অধ্যাপক। তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে, এদেশের নাট্যাভিনয়কে সর্বপ্রথম ‘এলিট‘ শ্রেণির কাছে সমাদৃত করে তোলা এবং তিনিই সবার আগে অভিজাত ঘরের নারীদের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসেন। নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন এবং তাঁর চরিত্রের অভিনয়শিল্পী শিশির কুমার ভাদুড়ীর প্রয়াণ দিবস একদিন আগে ও পরে। মাইকেলের ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে, শিশির কুমারের ১৯৫৯ সসালের ৩০ জুন বারাকপুরে। বাংলা নাটকের এই দুই ক্ষণজন্মা প্রতিভাকে আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইকেলের স্বভাবজাত যে বৈশিষ্ট্য সবার কাছে ধরা পড়ে সেটি হচ্ছে তাঁর বিদ্রোহ মানস। এই দ্রোহ চেতনা আমরা প্রথমে লক্ষ্য করি সমাজজীবনের নানা সংস্কার–কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং সাহিত্যে প্রচলিত রীতিনীতির ক্ষেত্রেও। ‘মেঘনাদ বধ‘ কাব্যে তিনি সনাতন ধারার ধর্ম বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন এবং পাশ্চাত্য আদর্শে এক নতুন আঙ্গিক বাঙালির মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ‘শর্মিষ্ঠা‘, ‘কৃষ্ণকুমারী‘, ‘পদ্মাবতী‘- এসব নাটকেও তিনি পেশীশক্তির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন এবং দেশপ্রেম ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। সমালোচকদের মতে আধুনিক বাংলা নাটকের জন্মদাতা মাইকেল। ড. রফিকউল্লাহ খান ও সৌরভশিকদার তাঁদের গবেষণায় বলেন, বাংলা নাটকের দুর্দশা মোচনে ‘শমিষ্ঠা‘ নাটক লিখে
তাঁর বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু। এর আগে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকের সংস্কৃত অনুবাদ দেখে তিনি ক্ষিপ্ত হন এবং বন্ধু গৌরদাসকে বলেন– ‘এসব আবর্জনার মধ্যে বাংলা নাটকের মুক্তি আসবে না।‘ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, নাটকের চাইতে দুটি প্রহসনেই মাইকেলের প্রতিভা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছে। ইয়ং বেঙ্গলদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন এবং সমাজের পাপাচার–ভন্ডামির বিরুদ্ধের তাঁর বিদ্রোহ জেগে উঠেছে ‘একেই কি বলে সভ্যতা‘ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে বোঁ‘- দুটি প্রহসনে। তাঁর এই বিদ্রোহ চরিত্র প্রথম যিনি পর্যবেক্ষণ করেন, তিনি মধু সংলাপী নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য এবং ১৯৬৬ সালে তিনি একটি যাত্রাপালা লেখেন, যার নামই দেন বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন। পরে আমরা দেখলাম, মাইকেলের বিদ্রোহী সত্তার আরও বস্তুনিষ্ঠা ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্ট চিন্তাশীল গবেষক গোলাম মুরশিদ। তিনি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন, কবি নজরুল নন। নজরুলের বিদ্রোহ পরাধীন জাতিকে মুক্তিদানের লক্ষ্যে ইংরেজ বেনিয়ার বিরুদ্ধ, আর মাইকেল অধঃপতিত সাহিত্য ও সমাজনীতির বিরুদ্ধে চিরদিন উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। বাংলার দুরন্ত ছেলে শ্রীমধুসূদন। জন্ম কপতক্ষ নদ বিধৌত যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে। ধর্মান্তরিত হবার পর মধুসূদন থেকে হলেন মাইকেল। বাবা মুন্সী রাজনারায়ণ দত্ত ত্যাজ্যপুত্র করলেন। মা জাহ্নবী দেবি পুত্রশোকে অকালে মারা গেলেন। বাংলার ‘ধুমকেতু’ তাঁর সৃষ্টি সম্ভার দেশ ও জাতির জন্য অকাতরে ঢেলে দিয়ে নিজে হলেন রিক্ত নিঃস্ব দেউলিয়া। কী আশ্চর্য সৃজনী শক্তি মাইকেলের। মৃত্যুর পরেও মঞ্চে তাঁকে নিয়ে টানাটানি, তাঁর জীবননাট্য রচনার তুমুল প্রতিযোগিতা। বিগত শতাব্দীর ৪০ দশকে এমনি এক নাটকে মাইকেলের রূপসজ্জায় বাংলার রঙ্গমঞ্চে এসে দাঁড়ান শিশির কুমার ভাদুড়ী–এক আশ্চর্য কুশলী নট, নাট্যচার্য।
শিশির কুমারের পৈতৃক নিবাস হাওড়া জেলার সাতরাগাছিতে। জন্ম মেদেনীপুরে মামার বাড়িতে। বাবা হরিদাস ও মা কমলে কামিনী। স্কটিশচার্চ কলেজে বি.এ পড়ার সময় শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের ভূমিকায় যুবক শিশিরের প্রথম অভিনয়। শখের থিয়েটারে শেষ অভিনয় ১৯২১ সালে, গিরিশ ঘোষের ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস‘ নাটকে। ইতোমধ্যে ‘হ্যামলেট ও চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের পার্ট শেষ করেছেন এবং ১৯১৪ সাল থেকে বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরেজীর স্বনামধন্য অধ্যাপক। পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস নাটকে শিশিরের অভিনয়ের সমালোচনা প্রকাশিত হলে সমগ্র নাট্যাঙ্গণে তুমুল হইচই পড়ে যায়। সবারই একই প্রশ্ন ‘কে এই শিশির?’ কন্ঠস্বরের চাতুর্য, অপূর্ব আবৃত্তি ভঙ্গিমা, দেহসৌষ্ঠব, ব্যক্তিত্ব সবকিছু মিলিয়ে এক প্রতিভাবান উজ্জ্বল পুরষ। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে পেশাদার থিয়েটারের সঙ্গে শুরু হলো তার মঞ্চ অভিযাত্রা। আলোচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে: ক্ষীরোদ প্রসাদের আলমগীর, ডি.এল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত, শরৎচন্দ্রের ষোড়শী, শচীন সেন গুপ্তের গৈরিক পতাকা, নিতাই ভট্টাচার্যের মাইকেল। ১৯৪০–৪৫ সালের দিকে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন‘ নাটকে অভিনয় করেন শিশির, ও–দিকে রঙমহল থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্তের মহাকবি মধুসূদন চরিত্রে মঞ্চে এসে দাঁড়ান আরেক খ্যাতিমান নট অহীন্দ্র চৌধুরী। অভিনয় ছিল রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক। এ–বলে আমায় দেখ, ও–বলে আমায় দেখ। শেষ পর্যন্ত ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য এই বলে মীমাংসা করে দিলেন যে, রঙমহলে অহীন্দ্র চৌধুরী সমবেত দর্শকদের মুগ্ধ করেন। শ্রীরঙ্গমে শিশির কুমার শ্রেণি বিশেষকে প্রীত ও উৎসাহিত করেন। বিদেশি বন্ধুদের আমন্ত্রণে শিশির একবার ‘সীতা’ নাটক নিয়ে নিউইয়র্কে যান। সমগ্র ভারতবর্ষে বিদেশের মাটিতে কোন বাংলা নাট্য প্রদর্শনী এটাই প্রথম। ১৯৫৯ সালের ৩০ জুন বারাকপুর ট্রাংক রোডের দোতলা বাড়িতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই নটসম্রাট। উৎপল দত্ত লিখেছেন ‘মাইকেলের জীবন ট্রাজিক, যন্ত্রণাদীর্ণ।‘ আর সেই চরিত্রের সফল রূপকার নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী।
লেখক : যাত্রাশিল্পী, প্রাবন্ধিক; নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ফেলো।