মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ দ্বিশততম জয়ন্তী। আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যিনি যুগপ্রবর্তক, যিনি অমিত্রাক্ষর ও চতুর্দশপদী ছন্দের প্রথম কুশলী নির্মাতা, মহাকাব্যের জনক, পত্রকাব্য রচনার পথিকৃৎ, বাংলায় পত্রসাহিত্য ও প্রকাশিত বইপত্রে উৎসর্গরীতির প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা যিনি– আজ এই দিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায় এবং জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি।
মাইকেলের নাটক
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের পর বাংলা নাটক রচনার প্রয়াস পরিলক্ষিত হলেও তা ছিল অধিকাংশই যাত্রাপালাগানের অপভ্রংশ কিংবা ইংরেজী ও সংস্কৃত নাট্যানুবাদের ছড়াছড়ি। মধুসূদনের মানসলোকে তখন শেক্সপিয়ার, মিল্টন, কীটস কিংবা গ্রীক নাট্যাদর্শের আলোর ঝলকানি। ওই সময় ঘটনাচক্রে তিনি পাইকপাড়ার রাজাদের (ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, প্রতাপচন্দ্র সিংহ) প্রতিষ্ঠিত বেলগাছিয়া নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ দেখেন। মুহূর্তে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তিনি। বাংলায় উন্নতমানের নাট্য রচনার দায়বোধের কথা জানালেন বন্ধু গৌরদাস বসাককে। এভাবেই জন্ম নিল তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। প্রকাশকাল ২১ জুলাই, ১৮৫৮। এর এক বছর দুই মাসের মাথায় অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৯ ঐ মঞ্চেই প্রথম অভিনীত হয় শর্মিষ্ঠা। এরপর সংস্কৃত রীতিনীতি পরিহার করে আধুনিক ও পাশ্চাত্য নাট্য আঙ্গিকে তিনি সাজিয়েছেন কৃষ্ণকুমারীকে। শর্মিষ্ঠা যেমন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক ও পৗরাণিক নাটক, তেমনি প্রথম ঐতিহাসিক বিয়োগান্তক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী।’ এ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ণ ৮ ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৭, শোভাবাজার নাট্যশালায়। মধুসূদনের আরও কয়েকটি নাটক–পদ্মাবতী, সুভদ্রা, রিজিয়া ও মায়াকানন। গ্রীক পৌরাণিক আখ্যান অবলম্বনে পদ্মাবতী (১৮৬০) রচিত। ভাষা প্রয়োগের দিক থেকে একটি অনন্য রচনা এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম ব্যবহার গুণে পদ্মাবতী নাট্য ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। মায়াকানন প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৭৪ সালে। বাংলা নাটকের ক্রমবিকাশের ধারায় বহুল আলোচিত মাইকেলের দু’টি প্রহসন– ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ।’ গবেষক ও সমালোচকদের মতে, নাটকের চাইতে প্রহসনেই মাইকেল–প্রতিভা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছে। মাইকেলের কালজয়ী এবং অবিস্মরণীয় আরেকটি সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ১৮৬১ সালে ‘বাই এ নেটিভ’ ছদ্মনামে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ। এ অসাধারণ কাজটি তাঁকে আরও মহিমান্বিত করেছে। বাংলার ধূমকেতু তাঁর সৃষ্টি সম্ভার দেশ ও জাতির জন্যে অকাতরে ঢেলে দিয়ে নিজে হলেন নিঃস্ব রিক্ত দেউলিয়া। জীবননাট্যের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়িয়ে মধুকবিকে উচ্চারণ করতে হয়– ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়/তাই ভাবি মনে/জীবন প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায়/ফিরার কেমনে ?
নাটকে মাইকেল
মাইকেলের জীবননাট্যেও আমরা দেখি একের পর এক নাটকীয় ঘাত প্রতিঘাত, ইংরেজীতে যাকে বলা হয় ড্রামাটিক ক্লাইমেক্স। প্রাণ প্রাচুর্য, আনন্দ উল্লাস, প্রেম ভালবাসা ভরপুর জীবনের আলো এক সময় ফিকে হয়ে আসে। হতাশা, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, ক্ষোভ, বেদনা, অতঃপর দ্বন্দ্ব সংঘাত, করুণ যবনিকা। ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে……’ জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তাঁর এই এপিটাফ আমাদেরও যন্ত্রণা দেয়। অন্যদিকে জীবনীমূলক নাটক রচনার জন্যে এগুলো একেকটি উৎকৃষ্ট উপাদান। হয়েছেও তাই।
বিগত শতাব্দীর ৪০ ও ৫০ দশকে মাইকেল মধুসূদনের জীবন–চরিত নিয়ে রচিত হয়েছে ৪টি নাটক–বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) শ্রীমধুসূদন (১৯৩৯), মহেন্দ্র গুপ্তের মহাকবি মাইকেল (১৯৪২) নিতাই ভট্টাচার্যের মাইকেল মধুসূদন (১৯৪৩), অজয় চক্রবর্তীর মহাকবি (১৯৫২)। ১৯৬৬ সালে বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন নামে একটি যাত্রাপালা রচনা করেন মধুসংলাপী নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। যাত্রাপালাটি প্রথম মঞ্চায়িত হয় ১৯৬৬ সালে কলকাতায় নবরঞ্জন অপেরার উদ্যোগে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় যাত্রানট স্বপনকুমার। বাংলাদেশে এর প্রথম মঞ্চায়ন ১৯৭৩ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোরের সাগরদাঁড়িতে। উদ্যোক্তা যশোর জেলা প্রশাসক। পরিবেশনায় চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা।
মাইকেল চরিত্রে অভিনয় করেন স্বনামধন্য যাত্রানট আমাদের চট্টগ্রামের অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫–১৯৮৭)। এখন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৫১ বছর আগে সাগরদাঁড়ির ওই মঞ্চে মাইকেলের এপিটাফ যখন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবৃত্তি করছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস– ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল…’ তখন যাত্রা দেখতে আসা লোকজন মঞ্চের ওপরেই তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন ‘ওরে সাগরদাঁড়ির মধু কি আবার ফিরে এলো’ ! সাগরদাঁড়ির প্রথম মঞ্চায়নের ছয় বছর পর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম জাতীয় যাত্রা উৎসবে, ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা মঞ্চে এবং ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন যাত্রা সম্প্রচারের পর রাজধানী ঢাকা ও সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হন অমলেন্দু বিশ্বাস। সবাই বিস্মিত ! এ কী অভিনয় ! এ কী সম্মোহনী শক্তি ! সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক তো তাঁকে নিয়ে ৯৭ লাইনের দীর্ঘ একটি কবিতাই লিখে ফেললেন। শেষের দিকের দু’টি পঙ্ক্তি আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে– ‘অমলেন্দুর কণ্ঠে রজনীর পর রজনী তাই আমি চতুর্দশপদী বলে যাচ্ছি/অমলেন্দুর চোখে দিবসের পর দিবস তাই আমি এখনো বাংলাকে দেখছি।’
মাইকেল যাত্রানুষ্ঠানের ২০ বছর পর ১৯৯৩ সালে ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নিয়ে আসে বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন।’ মধু চরিত্রে অভিনয় করেন সালেক খান। একুশে শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রান্তে মঞ্চের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন এক নতুন মাইকেল, বিষয়ে নতুন, গঠনে নতুন, উপস্থাপনায় নতুন, যিনি লিখেছেন অপূর্ব কুন্ডু– তিনিও নতুন এব নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নতুন আঙ্গিকে এটিকে সাজিয়েছেন এবং দর্শকপ্রিয় করে তুলেছেন প্রাঙ্গনেমোর নাট্যদলের অনন্ত হীরা। নাট্যকারের দেয়া নাম পরিবর্তন করে তিনি নতুন নামকরণ করেছেন ‘দাঁড়াও….. জন্ম যদি তব বঙ্গে।’
উৎপল দত্ত লিখেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে মাইকেল এক ট্রাজিক ও যন্ত্রণাদীর্ণ চরিত্র।’ একেবারে কঠিন সত্য কথা। জীবদ্দশায় যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে চলছে নিত্য টানাপড়েন। জাতীয় পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে কোন জয়ন্তী নেই। নাগরিক সাহিত্যাঙ্গনে মাইকেল যেন ‘নির্বাসিত।’ কখনও ভাসছেন, কখনও ডুবছেন, কিন্তু জেগে উঠছেন না। অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার এখন বাংলা সাহিত্যের অমর স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন।
লেখক : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, যাত্রাশিল্পী, গবেষক।