মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়নে সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান

জাইকা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক । ৫ বছরে ১ লাখ শ্রমিক নেবে জাপান

| শুক্রবার , ৩০ মে, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মহেশখালীমাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগে (এমআইডিআই) সমর্থন জোরদার করার জন্য জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির প্রতি (জাইকা) আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে অঞ্চলটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘৩০তম নিক্কেই ফোরাম : এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সম্মেলনের ফাঁকে গতকাল বৃহস্পতিবার জাইকা প্রেসিডেন্ট ড. তানাকা আকিহিকোর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এমআইডিআই অঞ্চল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের প্রবেশাধিকারকে কাজে লাগিয়ে আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর, মহাসড়ক এবং রেলপথ তৈরি করছি, যা এমআইডিআই অঞ্চলকে নেপাল, ভুটান এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশের সঙ্গে যুক্ত করবে। খবর বাসসের।

জাইকা প্রথমে মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করছে, যার মাধ্যমে পুরো এমআইডিআই অঞ্চলকে একটি বন্দর, লজিস্টিকস, মৎস্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রিক হাবে রূপান্তরিত করা হবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের স্বপ্ন হলো এই অঞ্চলে একটি মেগাসিটি গড়ে তোলা। তিনি উল্লেখ করেন যে বিমানবন্দরগুলোও যাত্রী চাহিদা মেটাতে উন্নত করা হচ্ছে।

. তানাকা এমআইডিআই উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাইকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন, তবে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। উত্তরে অধ্যাপক ইউনূস এমআইডিআই প্রকল্প তদারকির জন্য একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়োগ এবং জাইকা ও অন্যান্য সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, এমআইডিআই এলাকায় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রপ্তানিমুখী উৎপাদন কারখানা স্থাপন করতে পারবেন। এ ছাড়াও সরকার এই অঞ্চলে একটি একচেটিয়া মৎস্য অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করছে, যাতে বড় মৎস্যজাহাজগুলো কার্যক্রম চালাতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, আমাদেরকে গভীর সমুদ্র মৎস্য আহরণে যুক্ত হতে হবে। বর্তমানে প্রতিবেশী দেশগুলোর মৎস্য জাহাজ আমাদের জলসীমা ব্যবহার করে, অথচ আমাদের ট্রলারগুলো গভীর সমুদ্রে চালানোর জন্য যথেষ্ট বড় নয়। আমরা যদি সক্ষমতা তৈরি করি তাহলে সেই মাছগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ করা যাবে। ড. তানাকা মন্তব্য করেন, সম্ভবত এই প্রথম তিনি কোনো বাংলাদেশি নেতার মুখে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের উদ্যোগ সম্পর্কে শুনলেন।

উভয় নেতা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচি, দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টা সম্পর্কেও আলোচনা করেন।

অধ্যাপক ইউনূস নিশ্চিত করেন যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার পর একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে তিনি তার আগের কাজে ফিরে যাবেন। এছাড়াও, রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা হয়, এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা মানবিক সহায়তা বৃদ্ধিতে জাইকার সমর্থন কামনা করেন। ড. তানাকা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় জাইকা অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

এক লাখ শ্রমিক নেবে জাপান : ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানিয়েছে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। গতকাল টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’ শিরোনামের এক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সব কিছু করবে। তিনি বলেন, এটা আমার জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও প্রেরণার দিন। এটি শুধু কাজ করার জন্য নয়, বরং জাপানকে জানারও দ্বার উন্মোচন করবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) দুটি সমঝোতা স্মারক সই করে। একটি স্মারক সই হয় কাইকম ড্রিম স্ট্রিটের (কেডিএস) সঙ্গে, যেটি জাপানবাংলাদেশের যৌথ একটি উদ্যোগ।

এই চুক্তির অধীনে কেডিএস ও বিএমইটির সহযোগিতায় বাংলাদেশের মনোহরদী টেকিনিক্যাল ট্রেইনিং সেন্টারে (এমটিটিসি) একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ সেল বা ইউনিট গড়ে তোলা হবে। সেটি করা হবে জাপানের ‘টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেইনিং প্রোগ্রাম’ (টিআইটিপি) ও ‘স্পেসিফাইড স্কিলড ওয়ার্কার্স’ (এসএসডাব্লিও) প্রকল্পের জন্য। কেন্দ্রটি পরিচালিত হবে ‘ড্রিম স্ট্রিট বিজনেস ট্রেইনিং সেন্টার’ (ডিএসবিটিসি) নামে।

দ্বিতীয় সমঝোতা স্মারকটি হয় জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কোঅপারেটিভস (৬৫টির বেশি কোম্পানির ফেডারেশন) এবং জেবিবিআরএর (জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি) সঙ্গে। এই স্মারকের উদ্দেশ্য হল, টিআইটিপি ও এসএসডাব্লিওর অধীনে জাপানে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি কৌশলগত কাঠামো গড়ে তোলা।

এনবিসিসি, জেবিবিআরএ ও বিএমএইটির সহযোগিতায় একটি কারিগরি কেন্দ্র গঠন করা হবে, যা জাপানের টিআইটিপি ও এসএসডাব্লিও প্রোগ্রামের জন্য একটি মডেল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হবে। এর নাম হবে ‘ভালোচাকরি ট্রেনিং সেন্টার’। জেবিবিআরএর মাধ্যমে করা এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে অন্যান্য টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও চালু করা হবে।

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বয়সই ২৭ বছরের নিচে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারের কাজ হলো তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া। শিজুওকার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন সমবায়ের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থার প্রতিনিধি পরিচালক মিতসুরু মাতসুশিতা বলেন, অনেক জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশিদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি মেধাবীদের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের প্রতিভা লালন করা আমাদের দায়িত্ব।

এনবিসিসি চেয়ারম্যান মিকিও কেসাগায়ামা বলেন, প্রায় ১৪ বছর আগে অধ্যাপক ইউনূস জাপানে এসেছিলেন এবং ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীদের সহায়তার গল্প বলেছিলেন। আমাদের ফেডারেশন তরুণ ও দক্ষ শ্রমিকের জন্য বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে দেখছে। তারা উভয় দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। আগামী পাঁচ বছরে আমরা এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

ওয়াতামি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট মিকি ওয়াতানাবে বলেন, বাংলাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল প্রতিবছর ১৫০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়। তারা এই সংখ্যা তিন হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারীরা জাপানের চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইনি অ্যান্ড স্কিল্ড ওয়ার্কার কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (জেইটিসিও) চেয়ারম্যান হিরোআকি ইয়াগি জাপানের শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও ভাষা শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে।

জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (এমএইচএলডব্লিউ) প্রতিমন্ত্রী নিকি হিরোবুমি বলেন, জাপানে জনসংখ্যা কমছে এবং সে কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সহায়তা প্রয়োজন পড়বে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, জাপানের জন্যও একটি আশাব্যঞ্জক দিক হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি দলই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় আ.লীগ নেতাসহ আটক ২, অস্ত্র উদ্ধার