শিশিরকণা গুহ। পরবর্তীতে নাম রাখা হয় শবনম খানম শেরওয়ানী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া চট্টগ্রামের একজন নারী। ছিলেন সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নানা ক্ষেত্রে তার অবদান থাকলেও সবকিছু ছাপিয়ে তার পরিচয় কেবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা লোকমান খান শেরওয়ানীর স্ত্রী হিসেবে। ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল তার অন্য সব অবদান। তবে এ মহীয়সী নারীর কর্মময় জীবনকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন আনোয়ারা আলম। তার গবেষণালব্ধ গ্রন্থ ‘শিশির থেকে শবনম অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী’-এ। বইটি এবার বইমেলায় বেরিয়েছে ‘শৈলী প্রকাশন’ থেকে।
নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে বইমেলায় গতকাল আনোয়ারা আলমের সঙ্গে আজাদীর কথা হয়। বললেন, শবনম খানম শেরওয়ানী শুধুমাত্র একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা লোকমান খান শেরওয়ানীর জীবনসঙ্গী নন, তিনি একাধারে বিপ্লবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রেডিওর স্বনামধন্য কথক ছিলেন। তার সব পরিচয় চাপা পড়েছে ইতিহাসের আড়ালে। শুধু একটি পরিচয়ে খ্যাত তিনি, লোকমান খান শেরওয়ানীর স্ত্রী। ইতিহাসের পাতায় কেবল তিনি অজ্ঞাত, অনামী ও অখ্যাত। তার ঐতিহাসিক ভূমিকা, অবদান ও অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাসেও লেখা হয়নি কিছু, সামান্যতম ইঙ্গিতও নেই। তাই আমি চেষ্টা করেছি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এ নারী যাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলেছে, তাকে তুলে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার। শিশিরকণা থেকে কীভাবে শবনম খানম শেরওয়ানী হয়ে উঠলেন সেটা তুলে ধরেছি।
তিনি বলেন, শিশিরকণা চট্টগ্রামে বড় হয়েছেন। খাস্তগীর স্কুলে পড়তেন। তখন তিনি কল্পনা দত্ত ও লোকমান খান শেরওয়ানীর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন রেলওয়ের বড় অফিসার। তাদের বাসা ছিল হাই লেবেলে। পরবর্তীতে যুব বিদ্রোহের পর উনারা চলে যেতে বাধ্য হন। লোকমান খান শেরওয়ানীর সঙ্গে উনার প্রণয় ছিল। জেলখানাতেই প্রণয়টা হয়। পরে তিনি নাম নিয়েছেন শবনম খানম শেরওয়ানী। শিশিরকণা গুহ কীভাবে শবনম খানম শেরওয়ানী হলেন, তার রাজনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেছি।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পুরুষের সাথে নবজাগ্রত নারীদেরও একটা গৌরবময় অংশ ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্ত্রী দীক্ষা সম্পর্কে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার ধীরে ধীরে অপসৃত হওয়ার সাথে সাথে নারী প্রগতির যত বিস্তার লাভ করে ততই নারীসমাজ সচেতন হয়ে ওঠে। তাদের মধ্য থেকে একেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র উদিত হয় রাজনৈতিক গগনেও। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নারীরা নিজেদের কীভাবে বিকশিত করে তুলেছিলেন তা গভীর তাৎপর্যময়। যদিও ইতিহাসে বর্ণিত আলোচিত ঘটনায় চিরকালই চাপা থেকেছে নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণের বিষয়টি। যেভাবে লেখা হয়েছে পুরুষের বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগ ও কর্তৃত্বময় জীবনযাপনের চিত্র, সে তুলনায় পুরুষতন্ত্রের দাপটে আড়াল থেকে গেছে নারীর কীর্তি।
আনোয়ারা আলম বলেন, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে আমার গবেষণাগ্রন্থ ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে নারী’ প্রকাশিত হয় শৈলী প্রকাশন থেকে। এ গ্রন্থে দু’একজন নারীর সাথে শবনম খানম শেরওয়ানীর বিষয়ে জানতে পেরেছিলাম। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে গবেষক শামসুল হোসাইন ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক ও প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হকের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত হয় লোকমান খান শেরওয়ানী জীবনকথা গ্রন্থ। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে শবনম খানম শেরওয়ানীর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন নাজমাতুল আলম। তার দুই বছর পর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে আমিও চ্যালেঞ্জ নিলাম। কিন্তু কাজে হাত দিয়ে দেখি সামনে শুধুই অন্ধকার। কোথাও কিছু নেই। না তথ্য, না উপাদান, না তথ্যের উৎস গুরুত্বপূর্ণ কেউ, যা গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে আমার সামনে ছিল শামসুল হোসাইন ও মাহবুবুল হক রচিত জীবনীগ্রন্থ লোকমান খান শেরওয়ানী, জীবনকথা গ্রন্থ ও মমতাজ লতিফ রচিত ‘খুঁজি তারে আপনায়’ গ্রন্থ। একই সাথে লোকমান খানকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিচারণ। এগুলোকে সাথে নিয়ে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি একজন মহীয়সী নারী শবনম খানম শেরওয়ানীকে আবিষ্কার করার। তবে আন্তরিকভাবে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও প্রেরণায় ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ড. বদরুল হুদা খান, ছোট মেয়ে নাসিমা জামান, আসাদ ভাই ও আমার ছাত্রী ডোনা। উনারা সাক্ষাৎকার পর্বের ভিডিওতে মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। জানি না কতটুকু পেরেছি।