মহিষের শিংয়ে বাহারি গহনা

কদর বাড়ছে তিন পার্বত্য জেলায়

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | শুক্রবার , ১৬ জুলাই, ২০২১ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির নিভৃত পল্লী নন্দেশ্বর কার্বারি পাড়া। সবুজ ক্যানভাসের মতই গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা পুর্ন বিকাশ চাকমা চার দশক ধরে মহিষের শিং থেকে তৈরি করছেন বাহারি গহনা। সনাতনী পদ্ধতিতে শিং থেকে হস্তচালিত কাঠের যন্ত্র থেকে তৈরি হয় চুড়ি, আংটি ও চন্দ্রহার (গলার গহনা)। প্রায় ৪ দশক ধরে এ পেশায় রয়েছেন তিনি। মহিষের শিং থেকে তৈরি এসব গহনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলায়।
সরেজমিনে দীঘিনালা উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে নন্দেশ্বর কার্বারি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় বসে শিং থেকে গহনা প্রস্তুতের কাজ করছেন পূর্ন বিকাশ চাকমা। যন্ত্র চালিয়ে তাকে সহায়তা করছেন এক সহকারী। আলাপচারিতায় পূর্ন বিকাশ চাকমা জানান, আমার পূর্বপুরুষেরা মহিষের শিং থেকে গহনা তৈরি করত। আমি ৪০ বছর ধরে হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটি, চন্দ্রহার তৈরি করছি। কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে মহিষের শিং সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি শিংয়ের দাম ১২শ টাকা। কেজি প্রতি পড়ে ২৫০ টাকা। তবে অনেক সময় মানসম্মত শিং পাওয়া যায় না। গহনা বানানোর জন্য শিংয়ের পুরত্ব থাকতে হয় ১ ইঞ্চি। মানসম্মত শিং না মিললে মানসম্মত গহনা তৈরি সম্ভব হয় না। তিনি জানান, গ্রামের নারীরা চুড়ি, আংটি ও চন্দ্রাহারের আগাম অর্ডার দেয়। প্রতি জোড়া চুড়ি বিক্রি হয় ১২শ থেকে ১৫শ টাকায়, আংটি ২৫০ টাকা এবং চন্দ্রহার বিক্রি হয় ৫শ থেকে ৬শ টাকায়। স্থানীয়দের পাশাপাশি তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে গহনার অর্ডার পাই। এসব গহনা বিক্রি করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয়। আমার ছেলেকেও এ কাজ শিখিয়েছি। একজন সহকারী নিয়ে কাজ করতে হয়। নিজের বানানো কাঠের যন্ত্র দিয়েই তৈরি করি এসব গহনা। পূর্ন বিকাশের সহকারী ধর্মজ্যোতি চাকমা জানান, নিজেরদের ঐতিহ্য রক্ষায় এ কাজ শিখছি। কাজ শেখার পাশাপাশি মজুরী হিসেবে দৈনিক ৩শ টাকা পাই। গহনার অর্ডার থাকলে কাজের চাপ বেশি থাকে। নাহয় চাপ কম। পুর্ন চাকমার ছেলে পিন্টু চাকমা জানান, জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখছি মহিষের শিং থেকে গহনা বানাতে। এখনো তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। আমিও বেশ কিছু গহনা বানানোর কায়দা রপ্ত করেছি। এটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে গহনা কিনতে আসে। বিশেষত গ্রামের নারীরা গহনার মূল ক্রেতা। আমাদের গ্রাম ছাড়া খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির অনেকে আসে গহনা কিনতে। অনেকেই মহিষের শিং থেকে বানানো গহনার উপর সোনার পাত বসিয়ে অলঙ্কার বানায়। এটি চাকমা সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক।
গহনা কিনতে আসা মেনিয়া চাকমা জানান, গ্রামের নারীদের কাছে শুনে দেখতে আসলাম। এ শিংয়ের গহনা আমার পছন্দ। এখানে এসে এক জোড়া হাতের চুড়ি ও কানের দুল অর্ডার করেছি। দামও সাশ্রয়ী। এসব গহনা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। শিং থেকে প্রস্তুতকৃত গহনা আমাদের ঐতিহ্য।
খাগড়াছড়ির বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাবারাং নির্বাহী পরিচালক ও গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, পাহাড়ি সমাজে মহিষের শিংয়ের গহনা ব্যবহারের ঐতিহ্য রয়েছে। সামন্তীয় প্রভু বা মহাজনরা একসময় আভিজ্যাতের প্রতীক হিসেবে হাতির দাঁতের গহনা ব্যবহার করত। ব্যয়বহুল হওয়ায় হাতির দাঁত ব্যবহারের সামর্থ্য যাদের ছিল না তারা মহিষের শিংয়ের অলঙ্কার ব্যবহার করত। তবে বর্তমানে মহিষের শিংয়ের গহনা খুব কমই দেখা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৮ বছর হলেই টিকার নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধকোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ