মহিষের দইয়ে মানবদেহে সংক্রমণে দায়ী অণুজীব

গরুর টক দই মানসম্মত

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

দেশে মহিষের দইয়ে পাওয়া গেছে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গে সংক্রমণের জন্য দায়ী অণুজীব ও ছত্রাক। তবে গরুর টক দই মানসম্মত। জনপ্রিয় দশ রকমের দইয়ের যাবতীয় ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের উপস্থিতি এবং পুষ্টিগুণ শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এই গবেষণার নমুনা বিশ্লেষণ করে তথ্য নিশ্চিত করার কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্যারি মার্শালের গবেষণাগারের গবেষকগণ। গবেষণাপত্রটি নেচার গ্রুপের ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি, দেশের বিভিন্ন দইয়ের মধ্যে পুষ্টিগুণের তুলনা, ভারী ধাতব ও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি যাচাই করে দেখা এবং বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি শনাক্ত করা। সামগ্রিকভাবে দেশীয় দইয়ের খাদ্যনিরাপত্তার মান কেমন তা যাচাই দেখাই ছিল এই গবেষণার লক্ষ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএসআইআর, বন গবেষণাগার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের যৌথ এই গবেষণা। এতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া ও কঙবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে পর পর তিন মাসে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা হয় এসব ব্র্যান্ডের দই। এরপর পিসিআর, জেল ইলেকট্রোফোরেসিস, অ্যামপ্লিকন সিকোয়েন্সিং (সিঙটিন এস ও আইটিএস), এটোমিক এবজর্পশন, স্পেকট্রোফটোমেট্রি পদ্ধতি ব্যবহার করে এই গবেষণায় দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ টক দইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস প্রজাতির অণুজীব পাওয়া গেছে, যা দুধ থেকে দই তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ।

গরুর টক দই ও মিষ্টি দই এবং মহিষের টক দই মিলিয়ে মোট ৩০৬ রকমের ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত হয় এই গবেষণায়। এর মধ্যে ২৮ রকমের ব্যাকটেরিয়া সবগুলো দইয়ে পাওয়া গেছে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস ছাড়াও ল্যাক্টোকক্কাস ও এরোমোনাস ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে বেশিরভাগ দইয়ে। মিষ্টি দইয়ে দেখা গেছে ক্ল্যাভেরোমাইসেস ও ক্যান্ডিডা ছত্রাকের আধিক্য।
এই গবেষণায় সবচেয়ে কম পিএইচ বা অম্লযুক্ত দইয়ে (টক) ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং সবচেয়ে বেশি পিএইচযুক্ত দইয়ে (মিষ্টি) স্ট্রেপটোকক্কাস প্রজাতির অণুজীবের আধিক্য দেখা গেছে, যা অণুজীবের সাথে দইয়ের স্বাদ এবং পিএইচের সম্পৃক্ততা নির্দেশ করে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস একটি উপকারী অণুজীব, যা হজমে সাহায্য করা এবং অন্য ক্ষতিকারক অণুজীবকে প্রতিহত করাসহ শরীরে বিভিন্ন ভূমিকা রাখে। স্ট্রেপটোকক্কাস প্রজাতিও হজম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে। এই দুটি ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য দেশীয় টক ও মিষ্টি দইয়ে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নির্দেশ করে।
তুলনামূলকভাবে মিষ্টি দইয়ে উপকারী অণুজীবের পরিমাণ কম। কয়েকটি ব্র্যান্ডে স্ট্রেপটোকক্কাস অণুজীবের পাশাপাশি ক্ল্যাভিসপোরা প্রজাতির ছত্রাকের বিপুল পরিমাণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে এ গবেষণায়। এর পেছনে অতিরিক্ত চিনি বা অন্যান্য দ্রব্য মেশানো একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা। ক্ল্যাভিসপোরা অতিরিক্ত চিনির উপস্থিতিতে বসবাস করতে পারে। এটি সরাসরি কোনো রোগের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী না হলেও খাবারকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে ফেলতে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
গবেষণায় দেখা যায়, পুষ্টিগুণের দিক থেকে টক দই অনেক বেশি এগিয়ে। টক দইয়ের সবগুলো ব্র্যান্ডে উপকারী খনিজ সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ মিষ্টি দইয়ের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে, যা দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু অধিকাংশ টক ও মিষ্টি দইয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জিঙ্ক পাওয়া যায়নি। জিঙ্ক মানবদেহের গঠন, বিকাশ ও প্রজননে সাহায্য করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, দইয়ের ক্ষেত্রে ৮-১১ মিলিগ্রাম/কেজি জিঙ্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেশীয় দইগুলোর ৭০ শতাংশ ব্র্যান্ডে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী দইয়ে ভিটামিন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়োডিন, ফসফরাস, আয়রন, জিঙ্কের উপস্থিতি দইয়ের পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করে। কয়েকটি টক দইয়ের ব্র্যান্ডে এর সবগুলো উপাদান পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশ কিছু দই বিশেষত মিষ্টি দইয়ে পুষ্টি উপাদান তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে। এতে দইয়ে আকাঙ্ক্ষিত পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।
অন্যদিকে, পাঁচটি ব্র্যান্ডের দইয়ে কপারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি মাত্রায়। তবে তা বিশেষ ক্ষতিকারক মাত্রায় পাওয়া যায়নি। অনেক দইয়ে টোটাল ফ্যাটের (মোট চর্বিজাতীয় উপাদান) পরিমাণ খুবই কম। (মিষ্টি দইয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে)। অধিকাংশ মিষ্টি দইয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টোটাল সলিড (মোট শক্ত/দৃঢ় পদার্থ) এবং সলিড-নন-ফ্যাটের পরিমাণ স্বাভাবিকের দ্বিগুণ, যা দই থেকে ফ্যাট অপসারণ এবং দইয়ে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণ করার ইঙ্গিত দেয়।
মহিষের দইয়ে নগণ্য পরিমাণে ল্যাক্টোব্যাসিলাস ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এন্টারোব্যাকটার, এসিনেটোব্যাক্টার, শিগেলা, ক্লেবসিয়েলা, সাইট্রোব্যাক্টার ও এরোমোনাস প্রজাতির অণুজীব পাওয়া গেছে, যা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী হতে পারে। যেমন পাকস্থলীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া ইত্যাদি। এদের মধ্যে এন্টারোব্যাকটার প্রজাতির অণুজীব সাধারণত গবাদী পশুর মলমূত্রে পাওয়া যায়, যা এসব প্রাণীর অন্ত্র সংক্রমণের জন্য দায়ী।
এছাড়া মহিষের দইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছত্রাক পাওয়া গেছে, যাতে আছে ক্যান্ডিডা, আয়োডোফেনাস, এপিওট্রাইকাম ও ট্রাইকোস্পোরন। এই ছত্রাকগুলো চুলকানি ও চামড়ায় সংক্রমণ, হজমে সমস্যা এবং রক্তে বিষক্রিয়ার জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। গবেষকেরা মনে করেন, মহিষের দইয়ের লবণাক্ত এবং ভিন্ন মাত্রার স্বাদ অবিক্রিত রাখার জন্য দুধ থেকে দই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোটানো হয় না, যা দইয়ে সংক্রামক অণুজীবের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রকল্প শেষ হয় ২০২১ সালের আগস্টে। বাজারের শীর্ষস্থানীয় টক ও মিষ্টি দইয়ের ব্র্যান্ডগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক, আর্সেনিক বা ভারী ধাতব পদার্থ তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়নি। এটা আশাবাদী ব্যাপার বলে মনে করছেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। তাঁর মতে, এটি দইয়ের নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। দেশে খুব বেশি মহিষের দই বিএসটিআই অনুমোদিত নেই। তাই একটিমাত্র জনপ্রিয় মহিষের দইয়ের নমুনা চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে মহিষের দইয়ের মাঝে বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য বিশ্লেষণ করা হয়। তবে দেশের মহিষের দইয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বুঝতে সবগুলো প্রচলিত মহিষের দই নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে। তিনি জানান, এই গবেষণার পরবর্তী ধাপে ২৫টি ভিন্ন প্রকরণের দই নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য আছে।
উল্লেখ্য, দইয়ের সব বাকটেরিয়া ও ছত্রাক একসাথে চিহ্নিত করার এ রকম গবেষণা বাংলাদেশে প্রথম।
নেচার রিসার্চের ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। সহ-প্রধান গবেষক ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মার্শাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজের গবেষক আলফ্রেড চ্যান ও কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ জাভেদ ফয়সাল।
গবেষকদলে ডেইরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. নাজমুল হক। গবেষকদলে আরো ছিলেন বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের গবেষক মোহাম্মদ জাকির হোসেন, বিসিএসআইআর চট্টগ্রামের বিজ্ঞানী গোলাম মোস্তফা ও আবু বক্কর সিদ্দিক। গবেষণাগারে পুরো কাজটি সম্পাদন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা ইয়াসমিন তানজিনা ও মেহেদী হাসান রুমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপার্বত্য অঞ্চলের পর্যটনকে কাজে লাগানোর আহ্বান তথ্যমন্ত্রীর
পরবর্তী নিবন্ধফোন করে ৪ মিনিটেই খতিয়ানের আবেদন