চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার সমগ্র অংশই যেন এক মৃত্যুকূপ, বিশেষ করে চুনতি জাঙ্গালিয়া এবং হাজি রাস্তার মাথা, প্রতিদিন ঘটছে ছোটবড় সড়ক দুর্ঘটনা, সড়কটি দিন দিন মানুষ খেকোতে পরিণত হচ্ছে। শুধু ঈদের তিন দিনেই পর পর ৪টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৬ জন। ইতোমধ্যে মহাসড়কের লোহাগাড়ার সমগ্র অংশ দুর্ঘটনার হট জুন হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়রা জাঙ্গালিয়া এবং হাজি রাস্তা এলাকা দুটিকে মরণফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যে সব কারণে কারণে চুনতির জাঙ্গালিয়া এবং চুনতি হাজি রাস্তা বার বার ঘটছে দুর্ঘটনা- ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল, লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানি, গাড়ির তুলনায় সরু রাস্তা, জাঙ্গালিয়ায় ঢালু সড়ক, হাজি রাস্তা এলাকা অতিরিক্ত আকাঁবাঁকা, দূরপাল্লার চালকদের অভিজ্ঞতা নেই এ সড়কে চলাচলে। মূলত এই ছয় কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।
চুনতি জাঙ্গালিয়ার একই স্থানে একই সময় ঈদের দিন দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। পরদিন একই স্থানে দুই মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে আটজন আহত হন। সম্প্রতি যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নিহত হন আরও ১১ জন।
দোহাজারী হাইওয়ে থানা পুলিশ ও নিরাপদ সড়ক চাই-লোহাগাড়ার অফিস সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, গেল ছয় মাসে শুধু জাঙ্গালিয়ায় ৬৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছেন অন্তত ২৯ জন। আহত অর্ধশতাধিক, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকে।
লোহাগাড়া ফায়ার সার্ভিস টিম লিডার রাখাল চন্দ্র রুদ্র জানান, তিনি সম্প্রতি তিনটি সড়ক দুর্ঘটনার উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তিনি জানান, লবণ পরিবহনকারী ট্রাক থেকে পড়া পানিতে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরীও একিই কথা বলেছেন।
এছাড়াও সড়কের দুই পাশ লক্কর ঝক্কর অবস্থা এবং রাত্রিবেলা মাটির গাড়ি থেকে ছিটকে পড়া মাটি কুয়াশার পানির সাথে মিশে পিচ্ছিল হয়, তাছাড়া বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, অদক্ষ চালক, গাড়ির এলইডি হেডলাইটের আলো, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল, অবৈধ বিলবোর্ড স্থাপনের কারণেও সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি।
নিরাপদ সড়ক চাই-লোহাগাড়া শাখার সোহাগ মিয়া নামের এক সদস্য বলেন, প্রযুক্তির এই বিশ্বায়নে গাড়ি দিন দিন বড় এবং লাক্সারিয়াস হচ্ছে কিন্তু প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি এই মহাসড়কে, যতই সতর্ক বার্তা এবং গতিরোধক দেওয়া হউক রাস্তা সম্প্রসারণ করা বা ৬ লেনে উন্নিত করণ ব্যাতীত দূর্ঘটনা কমানো প্রায় অসম্ভব।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল নোমান পারভেজ বলেন, কক্সবাজার পর্যটন নগরী হওয়ায় ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সারাদেশের পর্যটক এ পথ দিয়েই সেখানে যায়। ওয়ান বাই ওয়ান না হলে এ সড়কে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। জাইকা এ ব্যাপারে কাজ করছে। শীগ্রই ছয় লেনে উন্নীত হবে।
সম্প্রতি জাঙ্গালিয়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, শিগগিরই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া এখন থেকেই সড়কের উভয় দিকে এক কিলোমিটারের মধ্যে গতিরোধক স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
অলস পড়ে আছে উদ্যোগ-
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট শীর্ষক এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ৫ হাজার ৭০৯ কোটি ও বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা প্রদান করার কথা ছিল।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে একনেকে পাস হলেও এ প্রকল্পের মূল কাজ কবে শুরু হবে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে জাইকার প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন ও পরামর্শ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কনসালট্যান্ট নিয়োগের আগে আরও কিছু ধাপ শেষ করতে হবে। কনসালট্যান্ট নিয়োগ হলেও টেন্ডার দিয়ে কাজ শুরু করতে এ বছর শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছায় অগ্রাধিকার দিলে আমরা কাজ চলতি বছরই শুরু করতে পারব।
তিনি জানান, জাইকার অর্থায়নে মহাসড়কের পটিয়া, চানখালী, কক্সবাজারের মাতামুহুরী, চন্দনাইশের শঙ্খ ও বরুমতী খালের ওপর ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি অত্যাধুনিক পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে সুফল পাবে মানুষ।
অধিকাংশ দূর্ঘটনা হয় বিপজ্জনক বাঁকে-
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক এলাকাটি দখলদারদের কবলে পড়ে শুধু সংক্ষীর্ণই হয়নি, বেশ আঁকাবাঁকা ও বেহাল হয়ে আছে। অনেক স্থানে দখল হয়ে যাচ্ছে মূল সড়কও। চট্টগ্রাম থেকে তিন ঘণ্টার রাস্তা কক্সবাজারে পৌঁছাতে সময় লেগে যাচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। ঘটছে স্বজন হারানোর মত দুর্ঘটনাও। মহাসড়কটির জন্য স্থানভেদে ৬০ থেকে ১০৪ ফুট পর্যন্ত জায়গা অধিগ্রহণ করা থাকলেও দুই লেনের মূল সড়কটি ২৪ ফুটের ভিতরেই সীমাবদ্ধ, যেখানে দুটি দূরপাল্লার বাস মুখোমুখি হলে আরেকটি বাইক যাওয়ার জায়গা থাকেনা। সড়কের দু’পাশে অবশিষ্ট সব জায়গা বেদখল হয়ে গেছে, উপজেলা শহরগুলোতেও ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলে চলে গেছে। এরই মধ্যে মহাসড়কের কক্সবাজারের চকরিয়া অংশে আজিজনগর থেকে ডুলাহাজারা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়কে ৫৯৩টি অবৈধ স্থাপনা অনেক আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে উচ্ছেদ হয়নি সেসব।
শতাধিক বাঁক-
বিভিন্ন সময় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো সোজা করার কথা বলা হলেও অদৃশ্য কারণে তা হয়নি। পটিয়ার ইন্দ্রপোল থেকে চক্রশালা পর্যন্ত বাইপাস সড়ক নির্মাণ ও বাঁক সরলীকরণে ২০১২ সালে ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতায় প্রকল্পটি পরে আর বাস্তবায়ন করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তা দিলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পরে তা ফেরত নিয়ে যায়। এর পর অবশ্য নতুন প্রকল্প নিয়েছিল সড়ক বিভাগ। ৭৪ কোটি টাকায় ইন্দ্রপোল থেকে চক্রশালা পর্যন্ত ১ দশমিক ১ কিলোমিটার বাইপাস সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এটির আওতায় কিছু বাঁক সোজা করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও শতাধিক বাঁক আছে বিপজ্জনক অবস্থায়।
বাস্তব চিত্রে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মনসারটেক, গৈড়লারটেক, আমজুর হাট, পটিয়া পোস্ট অফিস মোড়, থানা মোড়, চক্রশালা, জলুয়ার দীঘি, খরনা মোড়, পশ্চিম পটিয়ার মইজ্যারটেক, আনোয়ারা ক্রসিং, শিকলবাহা, বোয়ালখালীর আপেল ড্রাইভারেরটেক, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় মোড়, রওশন হাট, পদুয়া, বারআউলিয়া, রাজঘাটা, আমিরাবাদ পুরাতন থানা, আধুনগর, চুনতি হাজি রাস্তা, চুনতি মিঠার দোকান, রামু, চৌমুহনী, রাবার বাগান মোড়, খুটাখালী, ডুলাহাজারা বাজার পয়েন্ট, চুনতী বাজার, ফরেস্ট গেট, জাঙ্গাইল্যার ঢালা, চকরিয়া কলেজ মোড়, হারবাং নতুন রাস্তার মোড়, গাছবাড়িয়া পায়রারটেক, বাগিচাহাট মোড়, ভাণ্ডারীপাড়া মোড়, কসাইপাড়া, সোনার বটতল, দেওয়ানহাট, দোহাজারী স্কুল, বিওসি মোড়, সাতকানিয়া রাস্তার মাথা, মিঠাদীঘি, চারা বটতল, ঠাকুরদীঘি, বরইতলী মাদ্রাসা মোড়, গয়ালমারা ও ফাসিয়াখালী এলাকায় রয়েছে মরণঘাতী বিপজ্জনক বাঁক।