বাংলা কথা সাহিত্যের একজন স্বতন্ত্র্য ধারার লেখক, গণমানুষের কণ্ঠস্বর, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মী ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনকর্মী মহাশ্বেতা দেবী। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটোগল্প রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট গল্প, উপন্যাস জুড়ে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ সুস্পষ্ট।
ঢাকার আরমানিটোলার ১৫ নং জিন্দাবাহার লেনের মামা বাড়িতে ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মনীষ ঘটক এবং মাতা ধরিত্রী দেবী। বাবা ছিলেন একাধারে কবি ও সাহিত্যিক। মা–ও কবি ছিলেন। পিতা মনীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং তাঁর কাকা ছিলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক। তিনি ছিলেন পিতা–মাতার নয় সন্তানের মধ্যে সবার বড়। ১৯৪৬ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ পাস করেন। মহাশ্বেতা দেবী শুধু কথাসাহিত্যিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনকর্মীও। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল হাজার চুরাশির মা, রুদালি, অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি।
‘ঝাঁসীর রাণী’ মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম গ্রন্থ। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি লেখক হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। লক্ষ্মী বাঈয়ের জীবনী নিয়ে লেখা এই বই নিছক জীবনীগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে হয়ে উঠেছিল আরও অন্যকিছু।
আর সে জন্যই গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই সবার কাছে পরিচিত ও লক্ষণীয় হয়ে ওঠেন। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর ভিন্নধর্মী অবস্থান তাঁকে সমর্থন ও সম্মান দিয়ে অভিনন্দিত করেছে।
মহাশ্বেতী দেবী ঘরে বসে কল্পনার আঁকরে কোনো কিছু রচনা করেননি। যা দেখেছেন, আহরণ করেছেন তার আলোকে গল্প–উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর গল্প, উপন্যাসের কাহিনী–পটভূমি–চরিত্র তাঁর চেনা–জানা, দেখার ভুবন থেকে নেওয়া। তিনি ছুটে গেছেন সেইসব মানুষের কাছে যাদের জীবন সামাজিক কষাঘাতে জর্জরিত অধিকার ও মর্যাদাহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাইতো তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ছত্রিশগড় রাজ্যের আদিবাসীদের জীবন দেখতে ছুটে গেছেন তাদের মাঝে। দেখেছেন, আহরণ করেছেন লেখার উপাদান। প্রত্যক্ষ করেছেন নির্মম বাস্তবতা।
তাঁর সাহিত্য নিজের দেখা সময়ের পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত। তিনি অনেকের মতো তা উপেক্ষা করতে পারতেন। ঘরে বসে লিখতে পারতেন অনেককিছু। কিন্তু সামাজিক দায়, মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই, অসাম্য, অনাচার, রাষ্ট্রীয় বিমুখতা তাকে স্বতন্ত্র্য ধারায় লিখতে প্রচণ্ডভাবে তাড়িত করেছে।
তিনি ‘ঝাঁসীর রাণীর জীবনীগ্রন্থ’ খুব অল্প সময়ে লিখে ফেলেন কয়েক’শ পৃষ্ঠা। কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা থেকে যায় তাঁর। তৃপ্ত হতে পারেন না লেখায়। ওই অবস্থায় লেখা স্থগিত রেখে তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে ১৯৫৪ সালে বুন্দেলখণ্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। কয়েক মাস একা একা বুন্দেলখণ্ডের আনাচে–কানাচে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন রানি সম্পর্কিত আঞ্চলিক লোকগীতি, লোককাহিনি, জনশ্রুতি, কিংবদন্তি।
রানির ভাইপো গোবিন্দ চিন্তামণির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, রানির নানা স্মৃতিবিজড়িত স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। কলকাতায় ফিরে আবার নতুন করে লেখেন ‘ঝাঁসীর রাণী’।
এভাবেই মহাশ্বেতা দেবীর শুরু। তাঁর শুরুটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসকে আলাদা করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে পরবর্তী সময়ে আরো উচ্চতায় নিয়ে যায়। ‘ঝাঁসীর রাণী’র পর তিনি আরো বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেন।
মহাশ্বেতা দেবী বহুবার ভারতের আদিবাসী মানুষদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহিত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৪৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পথপ্রদর্শক। ১৯৪৮ সালে তাঁদের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। নবারুণ ভট্টাচার্য পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক,কবি ও রাজনৈতিক সমালোচক হয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। লেখাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার পর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখান থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় কমিউনিজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
মহাশ্বেতা দেবী একটি ডাকঘরেও চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কমিউনিস্ট মনোভাবের জন্য তাঁকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়।
তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে ‘হাজার চুরাশির মা’ অন্যতম। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ, মূর্তি, নীড়েতে মেঘ, স্তন্যদায়ীনি, চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর।
তাঁর লেখায় যেমন আছে মানবিক উপাখ্যান, তেমনি সময় ও কালের ইতিহাস। আদিবাসী মানুষের জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ নানা কারণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে তাঁর যে লেখালেখি, নিরন্তর সংগ্রাম এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে শুরু।
‘হাজার চুরাশির মা’ মহাশ্বেতা দেবীর এক অনন্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসটিকে লেখক মহাশ্বেতা দেবীর বাঁক পরিবর্তনের সূচনা পর্ব বলে অনেকে মনে করেন। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর ব্রতী ও তার বন্ধুদের আত্মোৎসর্গের এক মর্মস্পর্শী কাহিনী। সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ–উপন্যাসটি।
অধিকারহীন আদিবাসী মুন্ডা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের আলেখ্য ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি আদিবাসীদের মাঝে কাটিয়েছেন। তাদের নিয়ে লিখছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি আদিবাসীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি গল্প, উপন্যাস রচনা করেন। শতাধিক উপন্যাসের পাশাপাশি গল্পগ্রন্থ রয়েছে বিশটির মতো। তাঁর গল্পসমূহে আদিবাসী সমপ্রদায়ের নিগৃহীত জীবন, শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত নির্যাতন, বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছেন সামাজিক দায়, মানুষের মুক্তি ও মানবিকতার প্রতি প্রগাঢ় বোধ ও অপরিসীম মমত্ববোধের তাগিদে।
মহাশ্বেতা দেবী নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ ও ব্রাহ্মণ, ম্যাগসাইসাইসহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভূষিত করেন সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণে’।
২০১৬ সালের ২৩ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহাশ্বেতা দেবী কলকাতার একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। সেই বছরই ২৮ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়।