মহামারী মুক্ত হয়ে পৃথিবী আবার মুখরিত হোক উৎসবে

ফেরদৌস আরা রীনু | বুধবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

পহেলা বৈশাখের সকালে ভোরের প্রথম আলো সকলের মন রাঙিয়ে দেয় নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনায়। নতুনকে আহ্বানের উচ্ছ্বাস ‘পহেলা বৈশাখ’ তথা ‘বাংলা নববর্ষ’ বাংলা সংস্কৃতির এক বড় নিদর্শন। জাতিভেদে ভিন্নতা আসে আচারে- অনুষ্ঠানে কিন্তু উদ্দেশ্য একই— সবার মঙ্গল কামনা। তাইতো জাতি-ধর্মে- গোত্র সবাই এক রঙে রাঙিয়ে নেন এইদিন নিজেদের। সেই রঙ উৎসবের- সেই রঙ মনের আনন্দের— সেই রঙ সুখ আগমনের– সেই রঙ দুঃখ অবসনের। পার্থিব জগতের কোনো কিছুর সঙ্গে এর বিরোধ নেই।
‘হে নূতন,এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে’
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ পালন একটি প্রথা। সকল দেশে বছরের প্রথম দিন ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত। বাঙালি, ইরানি, চীনা, জাপানি, ইংরেজ, ফরাসি সবাই নিজ নিজ নববর্ষ উৎসব পালন করে। খৃষ্টান জগতে পয়লা জানুয়ারি পালিত হয় নববর্ষ। মুসলিম দুনিয়ায় নববর্ষ আসে মুহরম থেকে। ইরানিরা নববর্ষকে বলে ‘নওরোজ’, ইহুদিরা বলে ‘রাশ- হাসানা’ আর ভিয়েতনামের নববর্ষ হলো ‘তেত’। যে দেশে যেভাবে, যেনামে উদযাপিত হোক না কেনো নববর্ষের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ- উৎসব, শুভবোধ ও কল্যাণবোধ কামনা। সকল দেশেই এইদিনে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় নতুন দিনের জ্যোতির্ময় সূর্য। প্রকৃতি এইদিনে মুখরিত হয় নব জীবনের সংগীতে। সবুজ বৃক্ষের পত্রে পত্রে থাকে নতুনের পুলকই শিহরণ। গাছে গাছে পাখির কলকাকলীতে থাকে প্রভাতের বন্দনা গীতি। আকাশ সাজে নবোদিত সূর্যের আলোকের ঝরনা ধারায় অপরূপা।
নববর্ষের উজ্জ্বল ভোর বাঙালির জীবনেও আনে আনন্দবোধ। আনে সম্মিলন চেতন। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। জীর্ণশীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহ্বানে সামনে এগিয়ে যাওয়া, বাঙালির চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠা, প্রাণখুলে আনন্দে ভেসে যাওয়া এবং অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি -সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাঙালির নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। এটি বাঙালির সর্বজনীন লোক উৎসব –কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক।
বাঙালি ষোল আনা তার চিরচেনা রঙে, ঢঙে, রূপে ও বৈচিত্র্যে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবয়বে— পোশাক- পরিচ্ছদ, খাওয়া- দাওয়া, গান-বাদ্য ও নৃত্যগীত সবকিছুতেই থাকে বাঙালিয়ানার প্রাধান্য। হীনম্মন্যতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি প্রাণের নববর্ষ উৎসব পালন করে হৃদয়ের গভীর থেকে আনন্দ উল্লাসের সাথে। এইদিনটি বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। মানুষের হৃদয়ে উৎসারিত ধ্বনিতে সারা বাংলা আলোক প্লাবনে উদ্ভাসিত হওয়ার দিন। প্রত্যাশা- প্রার্থনা- দুঃখ জয়ের দিন। সর্ব জয়ী মানব শক্তি উপলব্ধি করার দিন। স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতার নির্মোক ভেঙে উৎসবে মিলনের দিন।

বাংলা নববর্ষ বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ। আমাদের প্রকৃতি ও সমাজ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, আমাদের জীবনাচার সবকিছুর সঙ্গে নববর্ষের যোগ। এর চেতনা হলো আনন্দলোকে সমবেত হয়ে সকলের আনন্দে যুক্ত হওয়া। নতুন আশা, নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রেরণার পাশাপাশি নববর্ষ আনে নতুন সাধনার প্রতিশ্রুতি। ইদানীং পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে বলা হচ্ছে আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। এই প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। বৈশাখে যখন খরার মাস, যখন কোন ফসল হতো না, তখন কৃষকের হাতে পয়সাও থাকতো না। তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করত।’ এই উক্তির রেশ ধরে আমরা বলতে চাই পান্তা-ইলিশ হয়তো বর্তমানে শহরের নাগরিক জীবনের নববর্ষ উদযাপনের একটি গৌণ অনুষঙ্গ।
আমরা জানি সম্রাট আকবর জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ‘ফসলি সন’ চালু করেন। যেটি কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিতি পায়। মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এদেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এদেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না বলে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা দেখা দেয়। তাই খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ‘বাংলা সনের’ প্রবর্তন হয়। বাংলা সন প্রবর্তন থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এসনের পরিচয় সুনিবিড়। গ্রামের সাধারণ মানুষ আঙুল গুনে বলে দিতে পারে বাংলা মাসের তারিখ।
বাংলা নববর্ষ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান, বলিখেলা ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান আগের দিনে মাস জুড়ে চলত। গ্রামে গ্রামে নববর্ষ পালনের আনন্দের ধুম পড়ে যেত। বৈশাখী মেলাতে লাঙ্গল,জোয়াল,মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাঁড়ি- পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র,শিশুদের খেলনা, মেয়েদের নানারকম গয়না এবং রসগোল্লা জিলিপিসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার বেচা- কেনা হয়। মেলায় অনুষ্ঠিত হয় নানা খেলাধুলা,গান,আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন। বৈশাখী মেলা শুধু গ্রামে হয় না। এটি শহরেও হয়। এই মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রাম শহরে যায় আর শহর গ্রামে চলে আসে।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল ‘হালখাতা’। গ্রামে- গঞ্জে- নগরে ব্যাবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরানো হিসেব-নিকেশ সম্পন্ন করে হিসেবের নতুন খাতা খুলতেন। এটিকে খোরের খাতাও বলা হতো। হালখাতা উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা সবাইকে মিষ্টি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। শহরের ব্যবসায়ী সমাজেও চিরাচরিত এই অনুষ্ঠানটি পালন করতে দেখা যায়।
আমাদের তিন পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালন করে। নববর্ষের এই উৎসব পাহাড়ে সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ আর ‘সাংগ্রাই’ আর ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে। এই তিন অনুষ্ঠান একত্রে ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
বাংলা নববর্ষ শুধু আমাদের বর্ষ সূচনার দিন নয়। নববর্ষ আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করে বর্তমানের মূল্যায়ন ঘটায়। জাতির আগামী দিনের রূপরেখাটির দিকনির্দেশনা দেয়।
১৪২৭ এর বাংলা নববর্ষ করোনার থাবায় মলিন চাদরে জড়ানো ছিল। আমরা আশা করেছিলাম ১৪২৮ এর নববর্ষ আমরা আগের মতই আনন্দঘন পরিবেশে পালন করতে পারব। কিন্তু গতবারের মতো এবারও আমরা করোনা নামক অনুজীবের ভয়ে ঘরে বন্দী। আমাদের মন বিষণ্ন। নেই কোনো আনন্দ উচ্ছ্বাস। চারিদিকে শুধু রিক্ততা। নেই কোনো কোলাহল। এদিনে আমাদের প্রার্থনা হবে নতুন বছরটি যেনো কল্যাণ বয়ে আনে আমাদের জন্য। আমরা যে দুঃসময় পার করছি তার যেনো শেষ হয়। বেঁচে থাকাটা এখন মুখ্য। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। নানা পদের ভর্তা, মাছ, পান্তা, খৈ-মুড়ি, রসগোল্লা, গজা খাওয়া হবে না ঠিকই কিন্তু আমরা আমাদের সামর্থ অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করতে পারি এদিনে। মহামারী মুক্ত হয়ে পৃথিবী আবার উৎসবে মুখরিত হবে—মুখরিত হবে বাংলার সকল ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। আমাদের জীবনের সকল নববর্ষ উৎসবের মর্মবাণী হবে— নতুন বছরে আমার আনন্দটুকু হোক সকলের আনন্দ। আমার মঙ্গলটুকু হোক সকলের মঙ্গল। সকলের সঙ্গে আমার যোগ হোক প্রীতিময়, সৌহার্দপূর্ণ এবং মহিমান্বিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপহেলা বৈশাখে লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের স্বপ্নকথা
পরবর্তী নিবন্ধমাহে রমজান ও তাকওয়া