স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনিক শনাক্ত রোগীর যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন দিচ্ছে, তাতে সংক্রমণ কমে আসার একটি ধারণা মনে জাগলেও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসায় ওই পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্র দিচ্ছে কি না সেই সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। যারা নিজে থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, কেবল তাদের তথ্যই সরকারি খাতায় আসছে। যাদের উপসর্গ সেভাবে নেই, তারা হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশের কোন এলাকায় কতটা ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস, সেই বিশ্লেষণও জানা যাচ্ছে না ওই পরিসংখ্যান থেকে। কাজেই পরীক্ষা বাড়িয়ে সঠিক চিত্র তুলে আনার ব্যবস্থা না হলে বাংলাদেশ ‘দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রে’ পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বে-নজির আহমেদ।
মার্চের শুরুতে ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর ছয় মাস পেরিয়ে এসে বাংলাদেশ তাহলে এখন মহামারীর কোন পর্যায়ে আছে? সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, সব মিলিয়ে আমরা একটা হতচ্ছাড়া অবস্থায় আছি। এভাবে চললে আমরা তো এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবই না, বরং দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণের দিকে যাব। তিনি বলেন, প্রতিদিন যে প্রতিবেদনটা দিচ্ছে, সেখানে সংক্রমণের মাত্রাটা কমছে। কিন্তু মহামারীর প্রকৃত চিত্রটা আমরা পাচ্ছি না। কোথায় সংক্রমণ বাড়ছে, কোথায় কমছে- আমরা জানি না। আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট করছি না। অ্যান্টিবডি টেস্ট দিলে বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের অবস্থাটা দেখতে পাব। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশে মহামারীর শুরু থেকে কেবল আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে করোনাভাইরাস শনাক্তের কাজ চলছে। এই পরীক্ষা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ, তবে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত। অন্যদিকে অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় জানা যায়, কারও শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না। অর্থাৎ, যারা আক্রান্ত হলেও উপসর্গহীন (অ্যাসিম্পটোম্যাটিক) ছিলেন এবং সেরে উঠেছেন, তাদের অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। আ তা করা গেলে জানা যাবে করোনাভাইরাস আসলে কতটা ছড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সময়ে দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজারের ঘরে। সেপ্টেম্বরে তা কমে এসে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজারের ঘরে থাকছে। এই সময়ে দেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাব বাড়লেও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। জুনের শেষ আর জুলাইয়ের শুরুতে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল, এখন তা ঘোরাফেরা করছে ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে।
সর্বশেষ যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়েছে তাতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আরও ১ হাজার ৫৪০ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৪ জনে। এক দিনে আরও ২৮ জনের মৃত্যু হওয়ায় দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ হাজার ৭২ জন হয়েছে। এদিকে ইউরোপ-আমেরিকার মত বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। খোদ সরকারপ্রধান আসন্ন শীত মওসুমে ভাইরাসের প্রকোপ আবার বাড়তে পারে বলে সতর্ক করে সেজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটিও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে একই ধরনের আশঙ্কার কথা বলেছে। এ বিষয়ে ডা. বে-নজির বলেন, দেশে ফার্স্ট ওয়েভই এখনও শেষ হয়নি। ইউরোপের অনেক দেশ বা চীন তো দৈনিক শনাক্ত রোগী শূন্যতে নামিয়ে আনল। আমরা ছয় মাসেও এটা পারলাম না। আমরা এটাকে বলছি, ওয়েভ ইমপোজড। অর্থাৎ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে যে ঢেউটা আছে, সেটার ওপর আরেকটা ঢেউ পড়বে। মানে আমরা নিচে নামব না।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছেন করোনাভাইরাস সঙ্কটে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ সহায়তা দিয়ে আসা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, আমরা যত বেশি শনাক্ত করব, তাদের আইসোলেশন করা ও কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে না। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে সংক্রমণটা আবার বাড়বে। যদি আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করি, তাহলে সেকেন্ড ওয়েভটা অনেক বড় হবে। বিদেশে কীভাবে মহামারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে কেমব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী মুশতাক বলেন, যারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে, তারা স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগিয়েই তা করেছে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করেছে। চীন নিয়ন্ত্রণ করতে পারল কমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে, আমাদের জেলা পর্যায়েও সে ক্ষমতা নাই। এই সক্ষমতা হঠাৎ বাড়ানো যাবে না। তবে ডাক্তার নিয়োগ করে, বাজেট দিয়ে, স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে পরীক্ষা বাড়ানোর চেষ্টা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর অবশ্য মনে করেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার আরও কমে আসবে। তবে মহামারী ‘কমে আসছে’ বলার মত পরিস্থিতি এখনো আসেনি বলেই মনে করেন আলমগীর।
নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করায় ইউরোপের কয়েকটি দেশ আবার বিধিনিষেধের মাত্রা বাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিন মানার তাগিদ দিয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বাইরে লকডাউনের মত কড়াকড়ি আরোপের কথা আপাতত ভাবছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, যেহেতু হারটা এখন কমের দিকে, আর জীবিকা নিয়েই মানুষ বেশি চিন্তিত, সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে যে সচেতনতার বার্তা আছে, সেটা চলবে। কিন্তু আইনগতভাবে কড়াকড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা এখন নাই।