শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গাপূজা আজ আমাদের জাতীয় উৎসব। ‘শারদোৎসব’ নামেও এই উৎসব সর্বস্তরে বহুল প্রচারিত। এই উৎসব বাঙালির একান্ত আপন উৎসব। আমাদের ‘তেত্রিশ কোটি’ দেব-দেবীর মধ্যে দেবী দুর্গা বিভিন্ন রূপে ও বিভিন্ন নামে অভিহিতা হয়েছেন। তিনি মহিষাসুর বধ করেছেন বলে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে ও নামে আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিতা ও পূজিতা।
‘শ্রীশ্রী চণ্ডীতে’ এই মাতৃশক্তির কথাই বলা হয়েছে। সমগ্র জগতব্যাপী এক শক্তিই ক্রিয়া করছে বিভিন্ন রূপে।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা’ সমগ্র জগতব্যাপী আজ বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি তার মূলে এই শক্তি। শক্তি আছে- এই কথা সকলেই স্বীকার করেন। আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। সমগ্র বিশ্বের মঙ্গলার্থে আমাদের ঈশ্বরের উপাসনা করা উচিৎ। ঈশ্বরের প্রথম অবতার ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি। জ্ঞানের সঙ্গে ইচ্ছা যোগ হলেই বিষয়টি বাস্তবায়িত হতে পারে। বাস্তবায়িত হতে হলেই ক্রিয়া শক্তি প্রয়োজন। সৃষ্টি-রক্ষা-ধ্বংস যেন হাত ধরাধরি করে চলে। মা সৃষ্টি এবং রক্ষা দুটোই করেন। ধ্বংস অনিবার্যভাবে আগে সৃষ্টির ক্রম রক্ষার জন্য। মানুষ বিপদে পড়লে মা-কেই ডাকে। ছোট শিশু মায়ের স্পর্শেই শক্তি পায়। আন্ত মানুষ ঘুমের মাধ্যমে মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চার করে কর্মে ঝাপিয়ে পড়ে। মানুষ সযত্নে, সস্নেহে বড় হয় মায়ের কোল থেকেই। সমগ্র বিশ্ব ‘মাতৃরূপেন সংস্থিতা’ বলেই মঙ্গল লাভ করেছে। আজ বিশ্বময় করোনা মহামারীতে মানুষ দিশেহারা। সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আধ্যত্মিক চিন্তা-চেতনা, পুষ্টিকর ও ভেষজ খাদ্যাভ্যাস, কুসঙ্গ পরিহার এরূপ জীবনযাপনে মানুষ ভাইরাস মুক্ত হবে এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শাস্ত্রের নিয়মাবলীরূপে গণ্য হয়েছে। নিজগৃহে প্রার্থনা, ধূপদীপ প্রজ্বলন, মাতৃ আরাধনার মাধ্যমে বিপদমুক্ত হবে বিশ্ব।
নানা সময়ে করোনা মুক্তির যে গুজব ছড়িয়েছে তাতেও আমরা দেখেছি মাতৃ আরাধনার কথা ফুটে উঠেছে। অতীতে যখনি বিশ্বে কোনো মহামারী সৃষ্টি হয়েছে তখনি দেবী দুর্গা নানারূপে মহামারী দমনে এই ধরাধামে আবির্ভূতা হয়ে আমাদের রক্ষা করেছেন। আমাদের উচিৎ স্বাত্ত্বিক পূজার মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনা করা। মা-ই পারেন আমাদের এই মহামারী থেকে রক্ষা করতে।
বর্তমানে করোনামুক্তির যে জীবনযাপন শুরু হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে মানুষকে তার নৈতিক ও মৌলিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। প্রকৃতি প্রকৃতির স্থানে, মানুষ তার আবাসস্থলে থাকতে হবে, যেমন- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে’। মহামারীর সাথে বাংলার যোগ ইতিহাসগতভাবে অনেক প্রাচীন। ইতিহাসে প্রথম মহামারী পরিচয় মেলে ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বিহারে। ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ রোগ, যার প্রভাব বাংলাতেও এসে পড়েছিল। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কলেরা ও বসন্তের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বঙ্গদেশে, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লু’র হাত থেকেও রক্ষা পায়নি বাংলা। ইতিহাসে উল্লেখ না থাকলেও যুগে যুগে মহামারী বিভিন্নরূপে আছড়ে পড়েছে মানব সমাজে। মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লৌকিক দেব ও দেবীর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর পূর্বে সুমেরীয় অঞ্চলের ‘নারগল’ দেবতাই হোক বা আমাদের বাংলার ‘শীতলা দেবী’, ‘ওলাই চণ্ডী’ বা ‘ওলাই বিবির’ উপাসনাই হোক। মল্ল রাজাদের কুলদেবী ‘মৃন্ময়ী’ দেবীর শারদীয় দুর্গাপূজার সময় পূজিত হন এই রকমই এক লৌকিক দেবী ‘মহামারী দেবী’। যুগে যুগে বিভিন্নরূপে মা-ই রক্ষা করেছেন তাঁর সন্তানদের।
দেবতা ও মানুষের মধ্যে ভেদ বহুবিধ। তন্মধ্যে একটি হল দিন ও রাত্রির পরিমাপে। মানুষের দিন বারো ঘন্টায়, রাত্রি বারো ঘন্টায়। দেবতার দিবা ছয় মাস, রাত্রি ছয় মাস। আমাদের মাঘ মাস হতে আষাঢ় মাস এই ছয় মাস দেবতার দিন। শ্রাবণ হইতে পৌষ মাস দেবতাদের রাত্রি। দেবতাদের দিনকে বলে উত্তরায়ন। রাত্রিকে বলে দক্ষিণায়ন। উত্তরায়নে দেবতারা জাগ্রত। দক্ষিনায়নে তাঁরা নিদ্রিত। শরৎকাল পরে দক্ষিনায়নের মধ্যে। দেবী ভগবতী তখন নিদ্রিতা। সেজন্য তখন দেবীকে পূজা করতে হলে দেবীর জাগরণের জন্য বোধন করতে হয়। শারদীয় পূজা-অকাল পূজা, বোধিত পূজা। শ্রীরামচন্দ্র এই শারদীয়া পূজা করেছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের এই দুর্গোৎসবের স্মরণেই আমাদের এই শারদীয়া মহাপূজা। মানব সভ্যতা আজ ভোগমুখী। ভোগ প্রবণতাই অকাল, আমাদের অকাল বোধন সফল হোক। বৃক্ষের পরিচয় ফলে, বিশ্ব মাতার পূজার বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের প্রসারে। মহাপূজার আয়োজনে উৎসবমুখর আমাদের জীবন আকাশের মতো উদার হোক, বাতাসের মতো স্নিগ্ধ মধুর হোক।
দুর্গাপূজা পরম ব্রহ্মের পরমাশক্তির আরাধনা। দুর্গাপূজার মাধ্যমে ঐশী শক্তিকে অন্তরে উদ্বুদ্ধ করে এবং সমাজদেহে সঞ্চারিত করে আমাদের মনে সকল অশুভ বিনাশপূর্বক চিত্তশুদ্ধি এবং বহির্জগতে সকল সমাজবিজ্ঞানী অপশক্তিকে নির্মূল করে সমাজদেহের সর্বত্র শুভশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের সাধনা। মাতৃশক্তির কণামাত্র যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি তবে সমাজ জীবন থেকে নারী নিগ্রহ বিলুপ্ত হবে, মাতৃ অবমাননার চির সমাধি রচিত হবে। এবং উত্থান ঘটবে এক বিশুদ্ধ বোধন শক্তির যার প্রভাবে সভ্যতা সুনির্মিতির দিকে এগিয়ে যাবে।
হে মহাদেবী! ভূতল তোমার ক্রিয়াভূমি, তাই তুমি এখানে আগমন করেছো। তুমি শত্রুরূপাও বটে, মিত্ররূপাও বটে, তুমি সর্বশক্তিরূপিনী মা, আমরা কায়োমনে প্রার্থনা করি সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী দাও। প্রত্যেকের জীবন ভরিয়ে দাও নির্মল আনন্দে। লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ এস্ট্রলজার্স সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি।