যে কোন দুর্যোগ কিংবা মহামারী লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে হাজির হয় না পৃথিবীতে। বিশেষ কোন শ্রেণির প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্বও নেই। তবুও বড় ভারটা ঠিক এসে পড়ে নারীর উপর। যেন ভারটা অনায়াসে নারীর উপরই দেওয়া যায়। বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধ চলছে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে তাতে নারীর মৃত্যু সংখ্যা কম হলেও চাপ বা ধকলটা বেশীরভাগ নারীর উপর দিয়েই যাচ্ছে। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে হলে প্রথম যে শর্তটা দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে দূরত্ব বজায় রাখা। নারীর পক্ষে কি সত্যি সত্যি দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব? নারীর স্বভাবজাত অভ্যাস এবং প্রয়োজনে নিজ তাগিদে পরিবারের যে কোন সদস্যের সেবায় নারীকে এগিয়ে আসতেই হয়। দূরত্ব বজায় রাখাটা নারীর পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। প্রথাসিদ্ধ সামাজিক নিয়মে সাংসারিক যাবতীয় কাজ নারীকেই করতে হয়। যতক্ষণ না সে বিছানা ছাড়তে না পারে! আমার জানা মতে অনেক নারী রান্নাবান্নাসহ সাংসারিক যাবতীয় কাজ চালিয়ে গেছেন কোভিড ১৯ পজেটিভ হওয়ার পরও! পরিবারের পুুরুষ সদস্যদের সেবা দিয়ে গেছেন অসুস্থ হওয়া অবস্থায়ও। করোনার অভিঘাত পারিবারিক জীবনে যেমন আঘাত হেনেছে তেমনি আঘাত হেনেছে সামগ্রিক অর্থনীতির উপরও। এখন “সীমিত পরিসর” শব্দটি বেশ প্রচলিত। পোশাক কারখানার ৬০ শতাংশ নারীকর্মী। এই সীমিত পরিসরের আওতায় তারা কাজ করছে। কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানাগুলো চালাচ্ছেন এবং কতটা নজরদারিতে তা আমরা জানি না। সে ক্ষেত্রে এসব নারীরাতো ঝুঁকিতে রয়েছেনই। বেতন নিয়েও চলছে মালিক পক্ষের নিত্য টালবাহানা। প্রান্তিক নারীদের অবস্থা আরও সংকাটাপন্ন। যারা বাসা বাড়িতে কাজ করতো তারা কাজ হারিয়ে দিশাহীন অবস্থা। আবার অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে অথবা অভাব অনটনে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে আসছে পারিবারিক সহিংসতার পরিসংখ্যান। অর্থনৈতিক সংকট শুধু আমাদের দেশেই নয় সারা পৃথিবী জুড়েই চলছে।
অর্থনীতিবিদ হেলেন লুইস সম্প্রতি করোনা দুর্যোগ নিয়ে আটলান্টিক গ্লোবাল পত্রিকায় লিখেছেন এটা শুধু জনস্বাস্থ্য ক্রাইসিস নয় অর্থনৈতিক সংকটও বটে। আর এই ক্রাইসিসে শেষ অবধি ভুগবেন নারীরাই। বিশ্ববাসী মহামারী নিয়ে সংগ্রাম করছে। এই সংগ্রামের শেষ কোথায় কেউ জানে না। এর সীমা পরিসীমা নিয়ে মানুষের কোন সুস্পষ্ট ধারণা এখনও পর্যন্ত নেই। বেঘোরে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে। নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। মহামারী লিঙ্গ বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীর আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তা বেড়েছে। জাতিসংঘের সমীক্ষা বলে, মহামারীতে নারীরা চিকিৎসক নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিন্তু বৈশ্বিকভাবে তারা তাদের পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে ১১% কম সম্মানি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই ধরনের বৈষম্য আরো জোরালোভাবে ফিরে আসবে। অনেক দেশে এরকম দৃষ্টিভঙ্গী খুব জোরালো যে কাজ দেওয়ার বেলায় মেয়েদের চাইতে পুরুষকেই বেশী অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ৩৪ টি দেশে পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে একথা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টার। লোকজনকে এই জরিপে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের সময় কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের অগ্রাধিকার থাকা উচিত কিনা। ভারত ও তিউনিসিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন পুরুষদেরই অগ্রাধিকার থাকা উচিত। জুলিয়ানা হরোউইটব হচ্ছেন পিউ রিসার্চ সেন্টারের একজন অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর। তিনি বলেন, যে সব দেশের লোকজন মুখে বলে যে, তারা লিঙ্গ সমস্যা সমর্থন করেন কিন্তু বিশ্বাস করে যে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় পুরুষদেরই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বিশ্ব জুড়ে ৪০ ভাগ উত্তরদাতা পুরুষের অগ্রাধিকারকে সমর্থন করে। তিনি বলেন মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে দেশগুলো যখন চেষ্টা করছে তখন এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী মেয়েদের কর্মসংস্থানের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।