মহামারির মধ্যেই বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে জানা গেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রিজার্ভ’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, গত বুধবার দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ০২৮ বিলিয়ন ডলার, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসেবে ১১ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। এতে আরো বলা হয়, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। তবে রেমিটেন্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় এক মাস না যেতেই রিজার্ভ আবার ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করল। আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। তার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের উপরেই থাকবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানি নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত। শুধু নিশ্চিত বিনিয়োগ নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবেও জনসংখ্যা রফতানিকে বিবেচনা করা যায়। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানির যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পারিশ্রমিক যাতে কাজ ও দক্ষতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সেজন্যেও সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জনসংখ্যা রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যদি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে, তাহলে জনসংখ্যা রফতানির সুফল ও রেমিটেন্স প্রবাহ আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক খাতের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হবে।
বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে রেমিটেন্স আয় আরো বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। বর্তমানে মোট উপার্জিত রেমিটেন্সের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও কোরিয়ার রেমিটেন্সের ২৩.৩০ শতাংশই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে নানা ঝামেলা থাকায় প্রবাসীদের অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে তাদের টাকা দেশে প্রেরণ করছে। জনশক্তি রফতানি খাতটি এখনো বলতে গেলে পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এতে বিদেশ গমনকারীদের যেমন বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তেমনি নানাভাবে প্রতারিত হতে হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে বিদেশে জনশক্তি রফতানি করা গেলে এ সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব হতো।
যেহেতু আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের ভূমিকা অপরিসীম, তাই এ আয় যেন কখনো না কমে, বরং কীভাবে তা বাড়ানো যায় সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনসংখ্যা এখন বিপুল, এই শ্রমশক্তিকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা দরকার, যেন তাঁরা বিদেশে চাকরির প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন। আর প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর অনানুষ্ঠানিক পন্থা নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করতে হবে। সে জন্য প্রচলিত ব্যাংকিং পন্থাকে আরও সহজ, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও লাভজনক করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ এখন রেমিটেন্স আহরণে পৃথিবীতে বড় জায়গা দখল করে আছে। কারণে-অকারণে সমালোচনাকারিগণের নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণিত করে দেশে রেমিটেন্স এসেছে প্রচুর এবং এর গতি দিনদিন ঊর্ধ্বমুখী। পশ্চিমা বিশ্বে আপাতদৃষ্টিতে জনশক্তি সেবা রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় এমনকি নেতিবাচক হবার ফলে ঐ সকল দেশে সব ধরনের শ্রমজীবীর সেবা, বিশেষ করে আধাদক্ষ শ্রমের চাহিদা বাড়তে বাধ্য। নইলে শ্রমের বদলে যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের সীমাবদ্ধতায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন একেবারেই ঠেকে যাবে। তাছাড়া সঠিকভাবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন-নতুন বাজার সন্ধানে সফলতা আসছে। তবে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক ও উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তি-প্রবণতায় জনশক্তি সম্পদে রূপান্তর করার কোন বিকল্প নেই।