মহাবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | শুক্রবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

আজ চট্টগ্রামবাসীর বেদনার দিন। বাঙালিরও অতীব দুঃখের দিন। চট্টগ্রাম বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর শিষ্য বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার আজকের এই দিনে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করে জীবনের জয়গান গেয়ে গেয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের তপস্যার পর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল পার্বত্য চট্টলার বন পাহাড়ের ওপাশ থেকে গাছপালার ফাঁকে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য উদিত হয়েছিল এবং ৯ মাস পর বঙ্গোপসাগরে সুনীল জলে সেই সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ৪১ বছর পর সেই স্বাধীনতা সূর্য আবার ছিনিয়ে আনলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আশ্চর্য! মাস্টারদার সূর্য সেন নামও স্বাধীনতার সঙ্গে প্রতীকায়িত হয়ে যায়। তাঁর অন্য নামও হতে পারতো। অন্য নাম হলে সূর্যের প্রতীকে স্বাধীনতা সমার্থক হতো না। কিন্তু যাঁকে একদিন সহস্র বর্ষের পরাধীনতার ঘন কৃষ্ণ জামিনীর বিবর ফুঁড়ে স্বাধীনতাসূর্য ছিনিয়ে আনতে হবে, তাঁর নাম সূর্য সেন হওয়াই বিধির বিধান।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে সূর্য সেনের জন্ম। পিতা রাজমনি সেন, মাতা শশীবালা। চার বোন দুই ভাই। ভাইদের মধ্যে সূর্য সেনই ছোটো। পাঁচ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে সূর্য সেন চট্টগ্রাম কলেজেই র্ভর্তি হন। আর এই কলেজ থেকেই তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.. পাশ করেন।

এই কৃষ্ণনাথ কলেজেই সূর্য সেনের জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই কলেজেই তাঁর অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছেই তিনি বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অধ্যাপক সতীশবাবু ছিলেন যুগান্তর দলের সভ্য। সূর্য সেন ছিলেন ছাত্র। তাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সূর্য সেন।

বি.. পরীক্ষা দিয়েই তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজারে উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে যান। ফলে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত।

এই সময়ে চট্টগ্রামে একটি বিপ্লবী দল গড়ে উঠেছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেনঅম্বিকা চক্রবর্তী ও অনুরূপ সেন। উভয়েই সূর্য সেনের পরিচিত, কোনো রকম দ্বিধা না করে সূর্য সেন ওই বিপ্লবী দলে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওই দলের নেতৃত্বভার এসে পড়ে তাঁর উপর। সূর্য সেন একদিকে বিপ্লবী নায়ক অন্যদিকে স্কুলের নামকরা অঙ্কের মাস্টার, ছোটো বড়ো সকলের দাদা। এই সব মিলে তিনিই মাস্টারদা। ইতিমধ্যে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের চাপে তিনি পুষ্পকুন্তলা নামে এক মহিলার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে তাতে তাঁর বিপ্লবী জীবনের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি বা তিনি স্বামীর দুর্গম পথে দুর্জয় অভিযানে কোনও বাঁধা সৃষ্টি করেনি।

বিপ্লবী সূর্য সেন চিরবিদ্রোহী বীর। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহের সাফল্যের উপরই নির্ভর করছে সারা ভারতের বিপ্লবের সাফল্য। তাই তিনি অত্যন্ত সতর্ক, যাতে তাঁর বিপ্লবী প্রস্তুতির পথে কোনো খুঁত বা ত্রুটি না থাকে। ভারতবর্ষের অতীত সংঘর্ষ বিদীর্ণ ইতিহাস তাঁর জানা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন বা সংঘর্ষ থেকে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, ঠিক তেমনভাবেই শিক্ষা পেয়েছেন অতীতের বিভিন্ন বিপ্লব প্রচেষ্টাগুলি থেকে ।

সারা ভারতের বিপ্লব পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ছোটো, সুসংবদ্ধ। কিন্তু সম্ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু একটা জেলা চট্টগ্রামের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকলেও সারা ভারতকে তাঁর পরিপূর্ণ বিপ্লবের পথ দেখাবে। ভারতবর্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের পর্যালোচনা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, একটি সীমিত অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সাময়িককভাবে পরাস্ত করে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। সে স্বাধীনতা দুইচার দিনের জন্য হলেও বা ক্ষণিকের জন্য হলেও তা সমগ্র দেশবাসীকে উজ্জীবিত করবে, অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর এই পরিকল্পনা যে কত বাস্তব, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে তিনি তাঁর প্রমাণ রেখে গেছেন। কালরাত্রির পরেই নতুন প্রভাত। আর এটাই ছিল মাস্টারদার স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতেই তিনি ১৯১৮ সালেই চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

অসহযোগ আন্দোলনের পর সূর্য সেন ও চারুবিকাশ দত্ত দেওয়ান বাজারের উকিল সুরেন দাশের বাসায় থাকতেন। পরে চারুবিকাশ দত্তের সাথে তাঁর মতানৈক্য ঘটে। বিপ্লবী দলে মহিলাদের স্থান দেয়ার বিষয় নিয়ে চারুবিকাশ দত্তের সাথে এই মতবিরোধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল সংগঠনের কাজ শুরু করেন। ১৯২০এ গান্ধীজীকর্তৃক বিপ্লবীদের কাছে এক বছরে স্বরাজ এনে দেবার প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০১৯২১) শুরু। এই গণআন্দোলনে বিপ্লবীরাও যোগ দিয়েছিলেন। এই সময় চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও যোগ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ঘটায় সমিতি ভাগ হয়ে যায়। ভাগ হওয়ার পর চট্টগ্রামের যে বিপ্লবী দলটি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কলকাতার ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে সহযোগিতা করতো সেই দলের সভাপতি ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। আরো ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ এবং নির্মল সেন। মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন তখন বিপ্লবীরা নিজেদের গোপন সংগঠন ও অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে আবার সক্রিয় হয়ে উঠলেন। ১৯২৩এর ১৩ ডিসেম্বর দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাস্তায় রেলওয়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭০০০.০০ টাকা ছিনতাই করা হয়। এতে অংশ নেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। এরপর পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সঙ্গে এক খণ্ডযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ নাগরখানা পাহাড় খণ্ড যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের পর সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করতে নাপারায় তাঁরা ছাড়া পান। পরে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে চার্লস টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টার পর কলকাতায় গ্রেফতার হয়ে ১৯২৮এ মুক্তি লাভ করেন। ১৯২৯এর প্রথম দিকে সূর্য চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে চারটি সম্মেলন সূর্যসেনের দলের উদ্যোগে ডাকা হয়। ১৯৩০এর শুরু থেকেই ভবিষ্যৎ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেন তিনি। ১৯৩০এর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল ও তার কয়েকদিনের মধ্যে জালালাবাদ পাহাড়ে কয়েকশত নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবীদের যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়, তাতে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দেড়শত বছরের মধ্যে সাময়িকভাবে হলেও ব্রিটিশরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এই দেশের মানুষের কাছে পরাজয়বরণ করে পলায়ন করে। এই দিক থেকে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করেন, তার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। ১৯৩০এর ১৮ এপ্রিল ছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের দিন এবং ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে সংঘটিত হয় মরণপণ যুদ্ধ। ইংরেজ সরকার সূর্যসেনকে গ্রেফতারের জন্য প্রচুর টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তাঁকে ধরতে এসে ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। অবশেষে ১৯৩৩এর ২ ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা গৈরলা গ্রামে শ্রীযুক্তা ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে গোপন অবস্থানের সময়ে একজন নিকট আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন। বিচারের সময়ে সূর্য সেনের বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ সরকার উপস্থিত করতে পারে নি। সঙ্গে রিভলভার পাওয়ার জন্য কেবল অস্ত্র আইনের সাজা হতে পারতো তাঁর, কিন্তু ইংরেজের বেতনভোগী বিচারক তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে দ্বিধা করেনি। এর বিরুদ্ধে সমস্ত আপিল বাতিল হয় এবং মাস্টারদা’র ফাঁসির হুকুম বহাল থাকে। দেশের স্বাধীনতার জন্য মাস্টারদা সূর্য সেন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রমোহন দস্তিদার, মাতার নাম প্রমীলা দেবী। তাঁর ডাক নাম ফুটু। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল ৭ম। ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে মাস্টারদা তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে গ্রামে এসে মিলিত হয়ে আত্মগোপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল। তখন রাত্রি ঠিক দ্বিপ্রহর। বহু সংখ্যক সরকারি, বোসরকারি ইংরেজ কর্মচারী এবং ফৌজি অফিসার দলবদ্ধভাবে জেলখানায় প্রবেশ করে এবং মাস্টারদা ও তারেকশ্বর দস্তিদার যে দুটি কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন সে দুটি কক্ষ খুলে সকলে মিলে মৃত্যু প্রতীক্ষাধীন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী বীরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর তাঁদের ওপর যে দৈহিক নির্যাতন চলে তা অবর্ণনীয়। তাঁরা উভয়েই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তাঁদের অচৈতন্য দেহ রুজ্জুতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রাণহীন দেহ তাঁদের আত্মীয়দের দেয়া হয়নি। পূর্বভারতীয় নৌবাহিনীর এক বিরাট ব্রিটিশ রণপোত ডিসেম্বরের শেষাশেষি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নোঙর ফেলেছিল।

১২ই জানুয়ারি (১৯৩৪) শেষ রাত্রেই উক্ত ক্রুজারখানি সূর্য সেন ও তারকেশ্বরের মৃতদেহ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলল কর্ণফুলীর মোহনা থেকে বঙ্গোপসাগরের প্রবল জলোর্মি ভেদ করে। পূর্বাকাশে প্রভাতসূর্যের উদয়শিখরে সুদূরে গাঢ় রক্তিমাভা ধীরে ধীরে সুনীল জলধির অসীমে মিলিয়ে যাচ্ছে। চট্টলসীমার বাইরে, দূরে আরও দূরে নীলাম্বুর বক্ষে শহিদযুগলের মরদেহ বিসর্জন দিয়ে সেই রণতরী সুদূর সিঙ্গাপুরের দিকে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুবকদের ব্যক্তিত্ব গঠনে স্বামী বিবেকানন্দ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা