১০ মাঘ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে বছরের ২৮৬ তম দিন। এ দিনের সাথে মাইজভাণ্ডারী ওরশের প্রধান দিবসের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এ তরিকার প্রবর্তক গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত মওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কাদ্দাসা সিররাহুল আজিজ) (১৮২৬–১৯০৬ খ্রি.)। ১৯০৬ খ্রি. ১০ মাঘ সোমবার এ দিনে ওফাতপ্রাপ্ত হন। প্রতি বছর ১০ মাঘ নিরবচ্ছিন্নভাবে এই ওরশ শরিফ গুরুত্বের সাথে পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে লাখো লাখো ভক্ত অনুরক্ত জায়েরিন ও আশেকিনের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে ফটিকছড়ি মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ। ওরশ শরিফে যোগ দিতে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেশ কয়েকদিন আগে থেকে আসতে থাকে ভক্তগণ। তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কাদ্দাসা সিররাহুল আজিজ) জীবদ্দশায় এ ওরশ শরিফের ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছিলেন। তাঁর ভবিষৎ বাণীর অনুকরণ ও অনুসরণে প্রতি বছর সাজ্জাদানশীনে দরবারে গাউছুল আজম আলহাজ্ব হযরত মওলানা শাহ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করেন। কুরআন–সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামের মৌলিক আদর্শের অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত এ তরিকার প্রচার প্রসার ও সৃষ্টির সেবায় ১লা মাঘ থেকে সাজ্জাদানশীন হুজুর কেবলা এঁর আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা হয়। ওরশ শরিফে উপস্থিত ব্যক্তিরাই হলেন মেহমান, আর মেহমানগনের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন করা ঈমানের পরিপূর্ণতা। হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, যে আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমান রাখে, সে যেন তাঁর মেহমানের সমাদর করেন। গাউছে পাকের দরবারের মেহমানগণের সার্বিক সহযোগিতার জন্যে অভ্যর্থনা ও জনসংযোগ, সংরক্ষণ ও সার্ভিস ব্যবস্থাপনা এবং তবারুক প্রস্তুত ও বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্ব প্রদান, স্বেচ্ছাসেবক গঠন করেন। নায়েব সাজ্জাদানশীন সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভাণ্ডারীর সক্রিয় সহযোগিতায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওরশ শরিফ পরিচালনা কার্যক্রমে জনসংযোগের বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। এ জনসংযোগের মধ্যে পোষ্টার লাগানো, লিফলেট বিতরণ, প্রচারপত্র ও তালিকাভুক্ত আশেকভক্তদের নিকট চিঠিপত্র পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করা দায়রা, আস্তানা শরিফের দায়িত্বে থাকা ও শাখা সংগঠনের একান্ত কর্তব্য। ওরশ শরিফে খাবার হিসেবে তাবরুক বিতরণ করা হয়। অপরকে খাবার পরিবেশন সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, “ইসলামের উত্তম কাজ খানা খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সবাইকে অধিকহারে সালাম দেয়া।” তাই অগণিত আল্লাহর বান্দাগণের খিদমত এবং আগত মেহমানগণের সম্মান ও ভালোবাসায় ওরশ শরিফের নজরানা সংগ্রহের মিছিলে প্রত্যেকের সাধ্যমত শরিক হওয়া দরকার। এতে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি ও অনাবিল প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। ওরশ শরিফের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারলে জীবনে ধর্মীয় আবহ– জড়িত প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। তবে নজর নিয়াজের নামে, ওরশের চাঁদার নামে কোনোভাবেই ভিক্ষাবৃত্তি, দ্বারে–দ্বারে, ঘরে–ঘরে, পথে–ঘাটে টাকা–পয়সা তোলা, চাওয়া, ওরশের নামে ধান্ধাবাজি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ হযরতের ওরশ শরিফ উপলক্ষে স্বতঃস্ফুর্তভাবে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে হাদিয়া প্রদান করলে তাই গ্রহণ করা হয়। এ ব্যাপারে হযরত কেবলার ১০ই মাঘের ওরশ শরিফের প্রথম পৃষ্ঠপোষক ও ব্যবস্থাপক সাজ্জাদানশীন, অছিয়ে গাউছুল আজম সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (১৮৯৩–১৯৮২) জরুরী বিজ্ঞপ্তি‘র মাধ্যমে সকলকে সতর্কবাণী পৌছিয়েছেন। তাঁর ভাষায় “হজরতের ওরশ শরীফ বা অনুষ্ঠান–প্রতিষ্ঠানাদির জন্য কারো নিকট থেকে যাঞ্চা, মাগা বা চাওয়ার নিয়ম নাই। স্বতঃ প্রদত্ত শ্রদ্ধা এবং ভক্তি সম্পন্ন হাদীয়াই গ্রহণ করা হয়। যাহা ‘খাইন’ শাসক কর্তৃক পাইকারী মত নহে” ।
১০ মাঘের ওরশ শরিফে যোগদান করতে নিজ উদ্যোগে পরিবহন ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেহেতু মুর্শিদ কেবলার নির্দেশ ‘মহান ১০ মাঘ এ প্রত্যেক সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক’। তাই দেশ–বিদেশে সর্বস্তরের জনগণের নিকট ১০ মাঘের দাওয়াত পৌঁছানো যেমন কর্তব্য; তেমনি তাদের জন্যে যাতায়াত, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থায়ও শরিক হওয়া কর্তব্য। ওরশ শরিফে আগন্তুক হিসেবে নিজে যেমন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার, তেমনি দরবার শরিফের পরিবেশ ও পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতে হবে। হযরত কেবলা স্মৃতিবার্ষিকী ওরশ শরিফ তাঁর উত্তরাধীকারী ও গদি শরিফের সাজ্জাদানশীন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় যাবতীয় কাজ সূচারূপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই ১০ মাঘ উপলক্ষে আনিত হাদিয়া–নজরানা দরবারি কায়দায় রওজা পাকে পেশ করে যথারীতি দরবারের আমদানি খানায় জমা করতে হবে। এ ব্যাপারে অছিয়ে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর নির্দেশনা হলো– ‘ওরশ শরীফের জন্য আনিত পশ্বাদি ও অন্যান্য সওগাত নজর নেয়াজ এবং খরচের টাকা– পয়সা ইত্যাদি দরগাহ পুকুরের সোজা পশ্চিম দিকে গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীনের নির্দিষ্ট আসনে দাখিল করতঃ নামীয় রসিদ গ্রহণ করিয়া ওরশ শরীফ নেয়াজের খেদমতে শরীক হইবেন।’
ওরশ শরিফ উপলক্ষে জায়েরিন আশেক–ভক্তের থাকার, খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ও নারী–পুরুষের পৃথক যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে তা কঠোরভাবে মেনে চলা আবশ্যক। নারীদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে বসে ফাতেহা পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, ইবাদত, জিয়ারত কার্য সম্পাদন করতে হবে। প্রতি ওয়াক্ত নামায যেন সঠিকভাবে আদায় করা হয় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে। আশেক–ভক্ত ও জায়েরিনগণের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা, আইন শৃঙ্খলার পরিবেশ সুরক্ষাসহ সকল বিষয় সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন নায়েব সাজ্জাদানশীন ও মোন্তাজেমে দরবার। তাই দরবার শরিফে এসে আশেক ভক্তরা প্রথমে রওজা শরিফ জিয়ারত করে হুজরা শরিফে সাজ্জাদানশীন, নায়েব সাজ্জাদানশীন ও আওলাদেপাক গণের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিৎ। এরপর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে চলে যেতে হয়। দরবারে এসে তরিকায় দাখিল হতে আগ্রহীকে বায়াতের দীক্ষা দিয়ে থাকেন ‘মনোনীত‘ একমাত্র সাজ্জাদানশীন আলহাজ্ব হযরত মওলানা শাহ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী। বায়াত প্রদানের সময় অনুযায়ী বায়াতী দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। নামায, জিয়ারত, মিলাদ, হালকা জিকির, ছেমা মাহফিল ও অন্যান্য আমল চলবে রাত বারটা পর্যন্ত। রাত ১২.০১ মিনিটে গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের শাহী ময়দানে হযরতের দোয়ার মেহরাব সম্মুখে কেন্দ্রীয়ভাবে মিলাদে নববী ও তাওয়াল্লাদে গাউছিয়া শেষে মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় ওরশ শরিফের আনুষ্ঠানিকতা। সাজ্জাদানশীন সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী হযরতের আনুগত্যের মেহরাবে পবিত্র হুজরা শরিফের সম্মুখে মিলাদ শরিফ, ইসালে সাওয়াব। ভক্ত আশেক, জায়েরিনদের নেয়াজ কবুল ও হাজত – মকসুদ পুরণার্থে এবং দেশ–জাতি ও বিশ্ব–মানবতার কল্যাণে মোনাজাত ও দোয়া কামনা করেন। এ মুনাজাতে সকলের শরিক হয়ে দু’জাহানের কামিয়াবি অর্জন করতে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। যেহেতু অছিয়ে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী জরুরী বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন, ‘ইহা হজরতের প্রতি আনুগত্যের মেহরাব হিসাবে পবিত্র হুজুরা শরীফের সম্মুখে মিলাদ শরীফ, ইছালে ছওয়াব, সকলের নেয়াজ কবুল ও হাজত মকছুদ পূরণার্থে মোনাজাত করে দোয়া কামনা করা হয়।’ মুনাজাতের পর নেয়াজ বিতরণের মধ্য দিয়ে ১০ই মাঘের ওরশ শরিফের আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটে। সেবকদল শৃঙ্খলার সাথে তাবারুক পরিবেশন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৩ ই মাঘ দিবাগত রাত বিপুল আয়োজনে তাঁর চাহরম শরিফ (ফলাহার ফাতেহা) অনুষ্ঠিত হয়। হযরতের স্মরণে ও ১০ই মাঘের স্মৃতি ও প্রীতির স্মরণে আয়োজিত এবং সাজ্জাদানশীন ও নায়েবে সাজ্জাদানশীনের আহ্বানে প্রতিটি কর্মসূচি যথাযথ পালন করে দোজাহানের কামিয়াবি হাসিল করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ আমাদেরকে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর ফয়েজ–বরকত লাভে তৌফিক নসিব করুন।
লেখক : প্রধান ফকিহ, চট্টগ্রাম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা, রিসার্চ ফেলো,
দারুল ইরফান রিচার্স ইনস্টিটিউট।