দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জনে বিশ্ব ইতিহাসে বাঙালি বীরের জাতির মর্যাদায় নিজেদের সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ভঙ্গুর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক–সামরিক–আঞ্চলিক বৈষম্যের চরিত্র ধারণকারী শাসকগোষ্ঠীর নব্য আন্তঃ–ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে বাঙালি জাতিকে চরম নিষ্পেষণে নিপতিত করেছিল। পাকিস্তানের শাসন–শোষণ–অত্যাচার–নির্যাতন–বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘসময় ধরে বাঙালির আন্দোলন–সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। স্বাধীন সত্তার বিপরীতে পরাধীনতার গ্লানি পরিহার করে মূলতঃ ১৯৪৮ সাল থেকেই মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাসীন করার অপোষহীন ব্রতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করে। বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন মহান স্বাধীনতার রোডম্যাপ তৈরিতে যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে প্রতিভাত। ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের সাবলীল গতিধারায় একাত্তরের মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার নতুন পথপরিক্রমা উন্মুক্ত করে।
আমাদের সকলের জানা, বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাপঞ্জিতে পরিপূর্ণ। ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পাঁচটি প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের উভয় নির্বাচনে বাঙালিরা একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক–বেসামরিক এবং ভূট্টোর দলের কূট অপকৌশলের নগ্ন অবিচ্ছেদে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে। কিন্তু ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা এবং গভীর রাতে সামরিক আইন পরিচালক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর–মতামত–চিত্র প্রকাশের ব্যাপারে সংবাদপত্রসমূহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১১০ নং সামরিক আইন জারি বাংলায় অবিস্মরণীয় এক দ্রোহী রূপ পরিগ্রহ করে। অধিবেশন বন্ধের আকস্মিক ঘোষণায় বাংলার আপামর জনতা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
বিক্ষুব্ধ বাঙালি এর প্রতিবাদে ১ মার্চ থেকে সারা দেশে চলমান ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলনে স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও উত্তাল মিছিল–স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলে। অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ২রা মার্চ হরতাল, মিছিল ও কারফিউর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। হরতাল চলাকালীন সামরিক জান্তার হিংস্র বাহিনীর গুলিতে তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র আজিজ মোর্শেদ ও মামুনসহ পঞ্চাশ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সামরিক আইন প্রশাসক ঐদিন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকল ৭ টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। কারফিউ ভেঙে বিভিন্ন স্থানে মিছিল–সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ৩ মার্চ মিছিলে গুলি বর্ষণে ঢাকায় ২৩ জন এবং চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হন। এই দিন পাঠ করা হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ইশতেহার। যেখানে বলা হয়, ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’।
৪ মার্চ ১৯৭১ গণ বিক্ষোভে এক দফার দাবী অর্থাৎ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় সামরিক জান্তার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ঐদিন খুলনায় বাঙালি অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং লাগাতার হরতালে কার্যত ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য স্বাধীনতার স্লোগান উচ্চারিত হলো, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন এবং গঠিত হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। উল্লেখ্য তারিখে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে পাকিস্তান সামরিক আইন আদেশ জারি এবং ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার করে। ঐ দিন বাংলার জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ডাক দেয় সাংবাদিক ইউনিয়ন। তারা মিছিল, জনসভার মাধ্যমে সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। স্বাধিকার আন্দোলনকে সফল করতে নিউজপেপারস প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভায় যে কোন ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প গ্রহণে প্রস্তাব গৃহীত হয়। একই তারিখে ২০ জন বিশিষ্ট শিল্পী যুক্তবিবৃতি দিয়ে বেতার–টেলিভিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া রেডিও পাকিস্তান ঢাকার নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ নামকরণের ঘটনা চলমান আন্দোলনকে বেগবান করে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
৬ মার্চ সভা–সমাবেশ–মিছিলে সমগ্র বাংলা অধিকতর উত্তাল রূপ ধারণ করে। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বেলা ১১ টায় সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। ঐ সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। ঐ দিন দুপুরে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে। ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগপ্রাপ্ত টিক্কা খানকে মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটির সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি পরিবর্তন করে ৯ মার্চ সামরিক শাসন পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার অবিনাশী বার্তা ঘোষিত হয়। ১০ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের যুক্তবিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার অনুরোধ জানানো এবং পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমানবন্দরে চেকপোস্ট বসিয়ে অবাঙালিকে দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার হুমকি প্রদান করা হয়। ১১ মার্চ ভূট্টো ঢাকায় আসতে রাজি আছে মর্মে তারবার্তা পাঠায়।
১২ মার্চ সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে সারা আলীর তোপখানা রোডের বাসায় অনুষ্ঠিত মহিলা পরিষদের সভায় পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়। একই দিন লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এর প্রতিবেদনে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি প্রয়োগ নিষ্পল ও বিপজ্জনক হবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক। পরের দিন সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি করে সকল বেসামরিক কর্মচারী যাদের বেতন প্রতিরক্ষা খাত থেকে দেওয়া হয় তাদের ১৫ মার্চ সকালে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পশ্চিমা শিল্পপতিরা ১৪ মার্চ সামরিক সরকারের প্রতি স্মারকলিপি প্রদান করে।
এভাবেই বহুমাত্রিক ঘটনার মধ্য দিয়ে একে একে পার হয় অগ্নিঝরা মার্চের ভয়াল ২৫টি দিন। গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনরত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে এ মাসেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ২৫ মার্চ কালরাত্রে বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে লক্ষ লক্ষ বাঙালির প্রাণসংহারে মেতে ওঠে। ২৬ মার্চ দিবসপ্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী স্ফুলিঙ্গে রূপান্তর ঘটে। ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী সরকার ঘোষিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল এই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুর, বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করেন। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ–রাষ্ট্রপতি এবং শহীদ তাজউদ্দিন আহম্মদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে সশস্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদান, দুই লক্ষ জননী–জায়া–কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে দুর্ধর্ষ যুদ্ধংদেহী পাকিস্তানি হায়েনাদের শোচনীয় পরাজয়ের পথ ধরে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে লালসবুজ পতাকার বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। প্রায় একানব্বই হাজার পাকিস্তান সেনা বাহিনীর দানব সদস্যদের আত্নসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সার্বিক বিবেচনায় মার্চ একাত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে অগ্নিঝরা স্পন্দন তৈরি করেছে, বাঙালি জাতির ইতিহাসে তার অভূতপূর্ব অবস্থান চিরস্মরণীয়। মুক্তিকামী বাঙালি মার্চ মাসকে যথার্থ অর্থে পরম আন্দোলনমুখী করতে না পারলে হয়তো মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপাঠ বিলম্বিত হত অথবা মুক্তির সকল প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই নিঃশেষ হয়ে যেত। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম পরিক্রমায় ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি কখনো অন্যায়–অসত্যের কাছে নত স্বীকার করেনি। শত দমন–পীড়ন, নিপীড়ন–নির্যাতন, হত্যা–গণহত্যার চরম বৈরীতাকে সংহার করে অর্জিত স্বাধীনতা অবশ্যই অর্থবহ করার যৌক্তিক সকল উদ্যোগ জরুরি। গণতান্ত্রিক–অসাম্প্রদায়িক–মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব ইতিহাসের অধ্যায়ে অপরাজিত থাকুক। কায়মনোবাক্যে উল্লেখ্য প্রত্যাশায় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ৩০ লক্ষ শহীদান ও ২ লক্ষ জননী–জায়া–কন্যার সর্বোচ্চ সম্ভ্রম ত্যাগের মহিমাকে। ধারাবাহিকতায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জুলাই ২৪ ছাত্র–জনতার অবিচল বৈষম্য–জুলুম মুক্তির যুদ্ধে শহীদ সকলের প্রতিও জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী।